উদ্যোক্তার গল্পদেশি উদ্যোক্তামতামত

আবেগের নিয়ন্ত্রণই উদ্যোক্তার আসল শক্তি : এলিন মাহবুব  

1
aleen

বাংলাদেশে উদ্যোক্তা হওয়া মানেই একদিকে সাহস, অন্যদিকে একটানা মানসিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হওয়া। ব্যবসার পুঁজির চাপ, ক্লায়েন্টের অনিশ্চিত আচরণ, বা কর্মীদের ভুল বোঝাবুঝি—সব মিলিয়ে একজন উদ্যোক্তাকে প্রতিদিনই নানা রকম মানসিক চাপ সামলাতে হয়। এই বাস্তবতার মাঝে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয় নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করা। কারণ, যতই বাহ্যিক পরিস্থিতি কঠিন হোক না কেন, আমাদের আসল শক্তি নির্ভর করে আমরা কেমন প্রতিক্রিয়া দিই তার ওপর।

বাংলাদেশি উদ্যোক্তাদের বাস্তবতা

আমাদের সমাজে ছোট-বড় সকল উদ্যোক্তাই এক প্রকার অদৃশ্য চাপের মধ্যে থাকেন। যেমন : একজন নির্মাণ ব্যবসায়ী হঠাৎ ক্লায়েন্টের কড়া মন্তব্যে আহত হন। একজন নারী উদ্যোক্তা প্রায়ই সামাজিক কটূক্তি বা অবমূল্যায়নের মুখে পড়েন। একজন তরুণ ফ্রিল্যান্সার বা ডিজিটাল উদ্যোক্তা নেগেটিভ কমেন্টে হতাশ হয়ে পড়েন।

এসব পরিস্থিতিতে আমরা প্রায়ই প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে যাই, শান্ত থেকে পরিস্থিতি বোঝার পরিবর্তে তা ব্যক্তিগতভাবে নিই। মনোবিজ্ঞানের ভাষায় একে বলে পার্সোনালাইজেশন—অর্থাৎ,“সবকিছু আমার বিরুদ্ধে” মনে করা। এই ভুল ধারণাই উদ্যোক্তার মানসিক স্থিতি নষ্ট করে দেয়, যা পরে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সক্ষমতা ও সম্পর্কের মানে প্রভাব ফেলে।

প্রতিক্রিয়া নয়, নিয়ন্ত্রণই নেতৃত্বের মূল

জিগ জিগলার  একবার বলেছিলেন—“কেউ তোমার অনুমতি ছাড়া তোমাকে অপমান করতে পারে না।” এই কথাটি উদ্যোক্তাদের জন্য অমূল্য। কারণ উদ্যোক্তার নেতৃত্ব মানে কেবল দল পরিচালনা নয়, নিজের আবেগও পরিচালনা করা।

একজন ক্লায়েন্টের রূঢ় আচরণ, কোনো টিম মেম্বারের ভুল বোঝাবুঝি, বা কোনো সরবরাহকারীর দেরি—এসব ঘটনা উদ্যোক্তার প্রতিদিনের বাস্তবতা। কিন্তু প্রতিটি ঘটনায় প্রতিক্রিয়া না দিয়ে একটু থেমে ভেবে দেখা—“এই আচরণটা কি সত্যিই আমার জন্য, নাকি সে নিজের চাপের কারণে এমন আচরণ করছে?” এই দৃষ্টিভঙ্গিই উদ্যোক্তাকে মানসিকভাবে পরিণত করে তোলে।

বাংলাদেশের  প্রেক্ষাপটে আবেগীয় নেতৃত্বের প্রয়োজন

আমাদের দেশে ব্যবসায়িক পরিবেশ এখনও অনেকটাই সম্পর্কনির্ভর। এখানে ক্লায়েন্ট বা কর্মী শুধু পেশাদার সম্পর্কের মানুষ নয়, অনেক সময় তারা বন্ধুত্ব, আত্মীয়তা বা সামাজিক সম্পর্কের অংশ। এই কারণে ব্যক্তিগত ও পেশাদার সীমানা প্রায়ই মিশে যায়।

আরও পড়ুনঃ ডিজিটাল বনাম ট্র্যাডিশনাল মার্কেটিং, উদ্যোক্তাদের জন্য কোনটা বেশি কার্যকর : এলিন মাহবুব

তাই, অপ্রয়োজনীয় অপমান না নেওয়া কেবল মানসিক পরিপক্কতা নয়, বরং ব্যবসায়িক বুদ্ধিমত্তাও। যে উদ্যোক্তা নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন, তিনি সম্পর্ক রক্ষা করতে পারেন, পরিস্থিতি ঠান্ডা মাথায় বিশ্লেষণ করতে পারেন, এবং দীর্ঘমেয়াদে সাফল্য পান।

আবেগ নিয়ন্ত্রণে দুই ধাপের মানসিক অনুশীলন

মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, আবেগ নিয়ন্ত্রণের দুটি ধাপ আছে—

১️. ডিপার্সোনালাইজেশন: কোনো কথা বা আচরণকে ব্যক্তিগতভাবে না নেওয়া।

২️. রিলেবেলিং: “রাগ” বা “কষ্ট” থেকে সেই আবেগকে “সহানুভূতি” বা “বোঝাপড়ায়” রূপান্তর করা।

বাংলাদেশের কর্মপরিবেশে যেখানে চাপ, ভুল বোঝাবুঝি এবং যোগাযোগের ঘাটতি খুব সাধারণ, সেখানে এই দুই ধাপের অভ্যাস উদ্যোক্তাদের জন্য আবেগ নিয়ন্ত্রণের উপায় হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।

একজন উদ্যোক্তার সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ তার মানসিক শান্তি। এই শান্তি বজায় রাখতে হলে প্রতিদিন সকালে নিজেকে মনে করিয়ে দিতে হবে—“আমি ঠিক করব কোন শব্দ, মন্তব্য বা আচরণ আমার মনে প্রবেশ করবে, আর কোনটা বাইরে থেমে যাবে।”

যখন আপনি নিজের প্রতিক্রিয়ার নিয়ন্ত্রণ নেন, তখনই আপনি শুধু একজন উদ্যোক্তা নন, আপনি নেতৃত্ব দিতে শিখেন—যিনি জানেন, সত্যিকারের শক্তি বাহিরের নয়, নিজের ভেতরেই থাকে।

এলিন মাহবুব  

স্বচ্ছ চিন্তায় গড়ে তুলুন সহজ ও শান্ত জীবন : জয়া মাহবুব 

Previous article

উদ্যোক্তার সকাল : সফলতার সূর্যোদয় এখান থেকেই – জয়া মাহবুব 

Next article

You may also like

1 Comment

  1. […] আরও পড়ুনঃ আবেগের নিয়ন্ত্রণই উদ্যোক্তার আসল শক্… […]

Leave a reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *