উদ্যোক্তার গল্পদেশি উদ্যোক্তা

টিউশনের টাকায় উদ্যোগ শুরু করেন মেহেরুন্নেসা মিলি

0
rmg 5

উদ্যোক্তা জার্নালের বিশেষ আয়োজন ‌ ‌‘উদ্যোক্তা গল্প’-র আজকের পর্বে, অনলাইনে নিজের উদ্যোগ নিয়ে আলাপ করেছেন মেহেরুন্নেসা মিলি। চলুন শুনি তার উদ্যোগের সফলতার গল্প।

আমি মেহেরুন্নেসা মিলি। জন্ম ঢাকার মিরপুর ১ এ মামার বাড়িতে। ওখানেই শৈশবের কিছুটা বেড়ে উঠা। এরপর বাবার সরকারি চাকরির সুবাদে মিরপুর ১৪ কলোনীতে চলে আসা। কলোনীর সাথেই ছিলো সেনাপল্লী হাই স্কুল। সেখানেই প্রথম পড়াশোনা জীবনের হাতে খড়ি।

ছোট থেকেই কেমন একা থাকতাম। বারবার মনে হতো আমাকে কেউ ভালোবাসেনা। ছোট বেলায় কেউ সেভাবে খেলায় নিতো না তাই বাসায় এসে কাঁদতাম। পরিবারের শাষন ছিলো কড়া। সেজন্য কখনোই ফ্রেন্ড সার্কেল গড়ে উঠেনি। ছোট থেকেই নিজের চারপাশে নিজে একটা বৃও এঁকে নিয়েছিলাম। বাইরে খুব একটা যেতাম না, ভালো লাগতোনা। আমার হাসি, কান্না ছিলো বই এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এভাবেই খুব নিরসভাবে কেটেছে স্কুল, কলেজ জীবন। জীবনের ২১টা বছরই কেটেছে আমার মিরপুর ১৪ তে। ওখানেই বেড়ে উঠা, পড়াশোনা সবটা।

271747452 498057235275092 3334632918002179998 n

২০১৯ সাল, কলেজের গন্ডি শেষ করে আমি তখন এডমিশন স্টুডেন্ট। প্রচন্ড মানসিক শক্তি ও সাহস নিয়ে ভর্তি হলাম মেডিকেল কোচিং এ। কোচিং এর পরীক্ষার নম্বরও বেশ ভালই ছিলো। আত্নবিশ্বাস মেডিকেলের প্রতি আরো বেড়ে গেলো। ধাক্কাটা খেলাম HSC রেজাল্ট দেবার পর, GPA 4.25। আমার মনে হচ্ছিলো আমি কাচের টুকরোর মত ভেঙ্গে গিয়েছি, তারউপর মার্কশিটের কপিটা আমার মুখের উপর ছুড়ে দেয়া হয়েছিলো।

ঘুমের ওষুধ নেয়া হতো প্রায়ই। মনে হতো একমাত্র ঘুমই মুক্তি দিতে পারে। পড়তে পারতাম না, বায়োলজি বইটা কে কতোবার বুকে জড়িয়ে কেদেঁছি। এডমিশন কি, এডমিশন টেস্টের গুরুত্ব কাউকেই বোঝাতে পারি নি। বোঝাতে চাইও নি। মনে হয়েছে, আমি পারবো। আম্মু তখন ডায়ালাইসিস এর পেশেন্ট। হাসপাতালে যথেষ্ট সময় দিতে হতো আমার। সেখান থেকেই চলে যাই মেডিকেল পরীক্ষা দিতে। যা হবার তাই হলো পয়েন্ট এলো ৬২.৫। আমি চান্স পাইনি। জিপিএ এর জন্য ১৮ টা মার্ক কেটেছে। সেদিন কান্নাকাটি করিনি। কেনো জানি, মনে হয়েছে আমি চেষ্টা করেছি, কিন্তু পারিনি। এক পর্যায়ে উপলব্ধি করলাম সব ভুলে আমার সামনের দিকে তাকানো উচিত।

271930724 455600962969899 7689844522360428408 n

নিজের ব্যাক্তিগত কিছু সমস্যা, বাবা -মার অন্তদ্বন্দ, নিজেকে বিরক্ত লাগা, জিপিএ খারাপ, মেডিকেলে চান্স না হওয়া, ব্যর্থতাকে সহজে মেনে নিতে না পারা, একাকিত্ব, ভয়, আম্মুর অসুস্থতা সব মিলিয়ে মনে হচ্ছিলো আমি আমার মধ্যে নেই।

‘মেডিকো’ (মেডিকেল এডমিশন কোচিং সেন্টার) এর নিশী আপুর সাথে আমি বিষয়টা শেয়ার করি, বলেছিলাম আপু আমার কিছু ভালো লাগেনা। আপুর কাছেই প্রথম জানতে পারি ঢাকা মেডিকেলের সাইকোলজি বিভাগ সম্পর্কে। এডমিশন টেস্ট শেষ করে ঢাকা মেডিকেলে মানসিক বিভাগের ডাক্তারের সাথে আমি সব শেয়ার করি। উনি কাউন্সিলিংসহ বেশ কিছু মেডিসিন সাজেস্ট করেন।

কাউন্সিলিং ডিপার্টমেন্টে আমার জীবনের এন্জেল (আমার কাউন্সিলর) এক বড় আপুর সাথে পরিচয় হয়। কয়েকটা সেশন পর কোভিড এর জন্য অফ হয়ে যায়। শুরু হয় অনলাইন সেশন।

272223931 2980081002253804 7687834241978403413 n

সময় কাটানোর জন্য আমি প্রচুর পরিমানে ইউটিউব এ পড়ে থাকতাম। ইউটিউব থেকে প্রথমে পেপার ফ্লাওয়ার বানানো শিখি। ওখান থেকে টুকটাক হাতের কাজ শেখা। আমি কোনো কিছু বানিয়ে আগে আপুকে (কাউন্সিলর) ছবি দিতাম। প্রচন্ড উৎসাহ দিতেন তিনি। তার অনুপ্রেরনা পাবার জন্যই মনে হতো আমাকে নতুন কিছু করতে হবে। পেইন্টিং একসময় ছেড়ে দিয়েছিলাম, সেই রঙ তুলি আবার হাতে তুলে নিলাম। যদিও আমার কোনো প্রতিষ্ঠানে কাজগুলো শেখা হয়নি।

আমি আমার হাতের ক্রাফটগুলো ফেসবুকের স্টোরিতে শেয়ার করতাম। এক শ্রদ্ধেয় বড় ভাই এই স্টোরিগুলো দেখে তার ফ্রেন্ডকে সারপ্রাইজ গিফট দেবার ব্যাপারে কথা বলে এবং ২,০৪০ টাকা বিকাশ করে। তখন থেকে মনে হলো, না আমি আমার কাজকে প্রফেশনালি নিতে পারি। সেই থেকে শুরু আমার পেইজ The Greenroom এর।

271391268 1448577698878161 1415131887314252775 n

আর ২০২১ এর মাঝামাঝি তে শুরু The Flavours এর। হোমমেইড ফুড নিয়ে কাজ করার ইচ্ছে আগে থেকে ছিলো। উপযুক্ত পরিবেশ না পাবার কারণে The Flavours এর কার্যক্রম কিছুটা ধীরগতিসম্পন্ন।

আমি মুলত, , হলুদের গহনা (ব্রাইডাল, নন ব্রাইডাল), বিয়ের ডালা সাজানো, সারপ্রাইজিং গিফট, গহনা তৈরীর ম্যাটেরিয়ালসসহ বিভিন্ন এ্যাসেনশিয়াল ম্যাটেরিয়ালস নিয়ে কাজ করি।

তবে আমার দ্বিতীয় আরেকটি পেইজ আছে, তার নাম The Flavours। নাড়ু, হলুদের ডালার সন্দেশ, চিপস, স্পেশাল ফ্রুট কাস্টার্ডসহ ফুডস আইটেম নিয়ে কাজ করি।

272013581 278983150826489 6529138480881821448 n

আমাকে বেশিরভাগ মানুষ The Greenroom এর নামেই চেনে। The Greenroom এর শুরুটা হয়েছিলো আমার টিউশনের টাকায়। ১,০০০ টাকা দিয়ে কিছু ফ্লাওয়ার কিনে শুরু করেছিলাম।

আমার মতে একজন উদ্যাক্তা হতে সবচেয়ে বেশি এবং প্রথমত প্রয়োজন ধৈর্য্য। কারন, এখানে বিভিন্ন ধরনের মানুষের সাথে পরিচয়, বিভিন্ন ধরনের কাস্টমার হ্যান্ডেল করতে হয়। কখনো কখনো এদের ব্যবহারে আপনি কষ্ট পাবেন, ভেঙে পড়বেন। কিন্তু আপনাকে সবকিছু পিছনে ফেলে এগিয়ে যেতে হবে। আর অনলাইন উদ্যোক্তাদের জন্য আমার মনে হয়, ধৈর্য্য এর পরিমানটা আরো বেশি হওয়া উচিত।

একটা নতুন পেইজ ওপেন করা থেকে শুরু করে, নিজের পরিচিতি, বিশ্বস্ততা এবং পেইজের পরিচিতি পেতে যথেষ্ট সময়ের প্রয়োজন। এই সময়টুকুতে অনেক নতুন উদ্যোক্তা হারিয়ে যায়, হতাশায় ভোগে। যেটা মোটেও করা উচিত নয় বরং আরো বেশি উদ্যোগকে সময় দেয়া প্রয়োজন। যার জন্য দরকার একনিষ্ঠ ধৈর্য্য।

দ্বিতীয়ত, নিজস্ব কাজের প্রতি শ্রদ্ধা। আপনি হোমমেইড ফুড, ক্রাফট, ফ্রেবিক, কেটারিং, রেডি টু কুক ফুড যা নিয়েই কাজ করেন না কেনো নিজের কাজের প্রতি অবশ্যই বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা রাখতে হবে। কে কি মনে করলো বা কে কি বললো তা নিয়ে মাথা না ঘামানো।

 

271799852 479331473589231 7935967742682816696 n

তৃতীয়ত, “সততা এবং বিশ্বস্ততা”। আপনার সততা থাকলে বিশ্বস্ততা হবে এমনিতেই।

আমিই আমার প্রতিষ্ঠান বা পেইজের কর্নধার এবং কর্মী। একা হাতে আমি নিজে দুটো পেইজকে সামলাই। ছোট থেকেই আমার কোনো কিছু প্রয়োজন হলে চাইতে পারতাম না। দেখা গিয়েছে আমার কাছে যাতায়াতের ভাড়া নেই, আমি আব্বুর কাছে কয়েকবার গিয়েও মুখ ফুটে বলতে পারিনি আমার দরকার।

আমার বারবার মনে হয়েছে চাইবো কিভাবে, আমি ব্যাংক ভেঙেছি তার জন্য। আমি যেকোনো কিছু আগে নিজে সমাধান করার চেষ্টা করি, তারপর না পারলে সাহায্য নেই। আমার এই না বলতে পারার থেকেই মনে হওয়া কিছু একটা সোর্স বা নিজের কিছু দরকার। আরেকটা কারণ হলো, স্টুডেন্ট লাইফটা খুব দীর্ঘ একটি সময়। আমি চেয়েছি অনার্স লাইফে গতানুগতিক ধারার বাইরে কিছু করবো, যার জন্য আমাকে সবাই অন্য পরিচয়ে চিনবে। আমার নিজের বলে কিছু থাকবে। সেই থেকে আমার উদ্যোগের যাএা শুরু।আমার প্রতিষ্ঠান বলতে আমার পেইজটাই। আমি যদি এক বাক্যে বলতে চাই, তাহলে শুধু এটাই বলবো, সততা, নিশ্চয়তা এবং বিশ্বাসযোগ্যতা। যেকোনো প্রোডাক্টের কোনো খুঁত থাকলে আমি সেটাই আগে কাস্টমারকে বলার চেষ্টা করি এবং প্রোডাক্টটা কতদিন ভালো থাকবে বা রঙ টা নষ্ট হয়ে যেতে পারে কিনা, সব টা বলার চেষ্টা করি।

আমাদের দেশের প্রেক্ষাপট নারী কর্মসংস্থানের জন্য এখনো তেমন অনুকুলে নয়। তবুও অনলাইন প্ল্যাটফর্ম এই পরিস্থিতি কিছুটা কমিয়েছে। প্রতিবন্ধকতার অভিজ্ঞতা মোটামুটি। পার্সেল রিসিভ করে পার্সেলের পেমেন্ট না দেয়া, ডেলিভারি সার্ভিস সংক্রান্ত জটিলতা/অবহেলা, সোর্সিংয়ের প্রোডাক্টের দাম হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়াসহ বেশ কিছু প্রতিবন্ধতার মুখেমুখি হয়েছি এ পর্যন্ত।

262763768 195013776160139 5476398376397698502 n

দুটো পেইজ মিলিয়ে এখন পর্যন্ত অর্ডার সংখ্যা ৫০ এর অধিক। টিউশনির ১,০০০ টাকা দিয়ে শুরু করা উদ্যোগের ইনভেস্টও অনেক। দেখতে দেখতে আমার নতুন পেইজটা, ছোট্ট এই পেইজ থেকে ৬০,০০০ টাকার বেশি সেল হয়েছে আলহামদুলিল্লাহ। আমার সেবায় কাস্টমার সন্তুষ্ট, মাাশাআল্লাহ।

এ পর্যন্ত সরকারি বা বেসরকারি কোনো সহায়তা পাইনি, আবেদনও করিনি। আমার প্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে বড় অর্জন ভালোবাসা, উৎসাহ, বিশ্বাস এবং ভরসা। শুরু থেকে কিছু আগ্রহ, রেসপন্স ও ভালোবাসা পেয়েছি। যার জন্য কাজের প্রতি আগ্রহ আরো কয়েকগুণ বেড়ে গেছে।

আমার নিজস্ব একটা ব্র্যান্ড তৈরী হবে, এটা আমার ইচ্ছা এবং স্বপ্ন। The Greenroom এর নামে বড় একটা শোরুম হবে। এক নামে চিনবে সবাই। এখান থেকে প্রাপ্ত অর্থে একটা বৃদ্ধাশ্রম বা কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বৃওি চলবে। স্বপ্ন অনেক বড়, আর মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়।

রাষ্ট্রপতিকে আওয়ামী লীগের ৪ প্রস্তাব

Previous article

ঢাবির হল সম্মেলন অনুষ্ঠিত

Next article

You may also like

Comments

Leave a reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *