ই-কমার্সউদ্যোক্তার গল্পদেশি উদ্যোক্তা

ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম নারী উদ্যোক্তাদের জন্য আশীর্বাদ, কিন্তু অনলাইন হ্যারাসমেন্ট বাঁধা কেন : এলিন মাহবুব 

0
am2

ডিজিটাল বাংলাদেশের বিকাশ নারীদের অর্থনৈতিক অংশগ্রহণের দরজায় অভূতপূর্ব পরিবর্তন এনে দিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ই-কমার্স, অনলাইন মার্কেটপ্লেস—এই সব প্ল্যাটফর্ম নারীদের এমন এক স্বাধীনতার স্বাদ দিয়েছে, যা এক দশক আগেও কল্পনা করা কঠিন ছিল। এখন ঘরে বসে সন্তান সামলানোর পাশাপাশি একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যবসা দাঁড় করানো শুধু সম্ভবই নয়, বরং দ্রুত বিস্তার করার সুযোগও তৈরি হয়েছে। একটি স্মার্টফোন, ইন্টারনেট এবং সৃজনশীলতা—এই তিনটিই আজ নারীর আর্থিক স্বাধীনতার হাতিয়ার হয়ে উঠেছে।

তবে এই সম্ভাবনার আলোয় যখন নতুন এক পথ তৈরি হচ্ছে, ঠিক তখনই ছায়ার মতো এসে দাঁড়ায় আরেকটি বাস্তবতা—অনলাইন হয়রানি। যে প্ল্যাটফর্ম নারীর মুক্তির পথ খুলে দিচ্ছে, সেই একই প্ল্যাটফর্ম যেন অদ্ভুতভাবে তাকে বন্দি করে রাখার চেষ্টা করছে। অসংখ্য নারী উদ্যোক্তা প্রতিদিন সামাজিক মাধ্যমে অশালীন বার্তা, অবাঞ্ছিত মন্তব্য, ছবি চুরি, মিথ্যা রিভিউ, ভুয়া অ্যাকাউন্ট থেকে হুমকি—এ সবকিছুর মুখোমুখি হচ্ছেন। এর প্রভাব কখনো এতটাই ভয়াবহ হয় যে অনেক নারী ব্যবসাই বন্ধ করে দেন, অথবা লাইভে যেতে ভয় পান। ফলে ডিজিটাল স্পেস যেমন নারীর জন্য আশীর্বাদ, তেমনি তা এখন একটি নতুন ধরনের মানসিক চাপ এবং অনিরাপত্তার উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সমস্যাটা কেবল প্রযুক্তিগত নয়, বরং গভীরভাবে সামাজিক। সমাজের বড় একটি অংশ এখনও নারীর সাফল্যকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে শেখেনি। নারী যখন দৃশ্যমান হয়, নিজের ব্র্যান্ড তৈরি করে, নিজের সিদ্ধান্ত নেয়—তখনই কিছু মানুষের মনে জন্ম নেয় নিয়ন্ত্রণের বাতিক। যেন নারীর অগ্রগতি তাদের পুরোনো মানসিকতার প্রতি একটি চ্যালেঞ্জ। আর সেই চ্যালেঞ্জকে প্রতিহত করার পথ তারা খুঁজে পায় অনলাইন অপমান, হুমকি কিংবা স্টকিং-এর মাধ্যমে। এ যেন এক নতুন ধরনের “ডিজিটাল পিতৃতন্ত্র”, যা প্রযুক্তির দ্রুত অগ্রগতির মধ্যেও নিজের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখতে মরিয়া।

আরও পড়ুনঃ ভাইরাল কেক পট্টির আড়ালে লুকানো স্বাস্থ্যঝুঁকি, নজর দিতে হবে ক্রেতা ও উদ্যোক্তা দুই পক্ষকে : এলিন মাহবুব

বাংলাদেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ বেশ কিছু আইনি কাঠামো থাকলেও সেগুলোর বাস্তব প্রয়োগ এখনও সন্তোষজনক পর্যায়ে পৌঁছায়নি। অভিযোগ গ্রহণের পর ব্যবস্থা নিতে দেরি হয়, অনেক নারী ভয় বা লজ্জার কারণে অভিযোগই করেন না। ভুয়া অ্যাকাউন্ট শনাক্ত করা কঠিন হওয়ায় অপরাধীরা প্রায়ই ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। এতে নারীরা অসহায় বোধ করেন এবং অনলাইন উপস্থিতি সীমিত করে ফেলেন—যা তাদের ব্যবসায়িক অগ্রগতির পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

তবুও, এই সমস্যাগুলো নারীর অগ্রযাত্রাকে থামিয়ে দিতে পারেনি। হাজারো নারী প্রতিদিন অনলাইন প্ল্যাটফর্মে নিজেদের প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করে যাচ্ছেন। তাদের সফলতা প্রমাণ করে—সমাজ যতবার বাধা দেবে, নারীরা ততবারই আরও দৃঢ় হয়ে উঠবে। তবে রাষ্ট্র, পরিবার, সামাজিক কাঠামো এবং প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্ব এখানে গুরুত্বপূর্ণ। নারীর জন্য নিরাপদ ডিজিটাল পরিবেশ নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি। কারণ, নিরাপত্তাহীনতার ভেতর কোনো স্বাধীনতা পরিপূর্ণ হতে পারে না।

ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম নারীর ক্ষমতায়নের শক্তিশালী হাতিয়ার—এটা অস্বীকার করা যায় না। এই প্ল্যাটফর্মই লাখো নারীকে এনে দিয়েছে স্বপ্ন দেখার সাহস। তাই অনলাইন হ্যারাসমেন্টকে কোনোভাবেই ‘ডিজিটাল সংস্কৃতির অংশ’ হিসেবে মেনে নেওয়া যায় না। পরিবর্তন আনতে হবে মানসিকতায়, আইনের প্রয়োগে এবং প্রযুক্তির ব্যবস্থাপনায়।

নারীরা পিছিয়ে যাওয়ার মানুষ নয়; তারা নতুন পথ তৈরি করে এগিয়ে যাওয়ার মানুষ। তাই সময় এসেছে ডিজিটাল স্পেসকে সত্যিকারের নিরাপদ করে তোলার—যেখানে এক নারীর সাফল্য কারো অহংকারে আঘাত হানে না, বরং অনুপ্রেরণা হয়ে ওঠে পুরো সমাজের জন্য।

এলিন মাহবুব

সংসদের নারী আসনে সরাসরি নির্বাচনের দাবি

Previous article

নারী উদ্যোক্তাদের অদৃশ্য যুদ্ধ, ইমোশনাল লেবারের দাম কে দেবে : জয়া মাহবুব 

Next article

You may also like

Comments

Leave a reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *