উদ্যোক্তার গল্পদেশি উদ্যোক্তা

প্রত্যাশার বাস্তবতা খুঁজে পেয়েছেন আরিফা সুলতানা

2
Cherry Blossom Watercolor Facebook Cover 14

উদ্যোক্তা জার্নালের বিশেষ আয়োজন ‌‘উদ্যোক্তা গল্প’-র আজকের পর্বে, নিজের উদ্যোগ নিয়ে কথা বলেছেন আরিফা সুলতানা। চলুন শুনি তার উদ্যোক্তা জীবনের গল্প।

আমি আরিফা সুলতানা। আমার গ্রামের বাড়ি বরিশাল জেলায়। কিন্তু জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঢাকাতেই। আমার বাবা একজন সরকারি কর্মকর্তা ও মা গৃহিনী। আমি তাদের একমাত্র কন্যা। আমি কাকলি হাই স্কুল থেকে এসএসসি ও বাংলাদেশ রাইফেলস্ কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করি। এরপর ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে বিবিএ ও এমবিএ কমপ্লিট করি। বিবিএ করার পর ইন্টার্ন হিসাবে কিছু দিন ফাস্ট সিকিউরিটি ইসলামিক ব্যাংকে কর্মরত ছিলাম।

বিবিএ শেষ করে নিজের অধিক ইচ্ছা থাকা স্বত্বেও চাকরি জীবনে অগ্রগামী হতে পারিনি, কারণ ততোদিনে আমার বিবাহিত জীবনে পদদর্পন করা হয়ে গিয়েছিলো। ২০১৩ সালে আমার প্রথম সন্তান জন্ম গ্রহণ করে, তাই চাকরি থেকে ছেলেকে সময় দেয়াটা জরুরি মনে করেছিলাম। সে সময় ছেলেকে সময় দেয়ার পাশাপাশি এমবিএ কমপ্লিট করি। ২০১৯ সালে আমার দ্বিতীয় সন্তান জন্ম গ্রহণ করে যার কারণে চাকরি বিষয়টা আমার জন্য আরো কঠিন হয়ে যায়।

তবে মনের ভিতর একটা ছোট বাসনা রয়েই গিয়েছিলো যে সংসারে সব গুছিয়ে নিজেকে একটা অবস্থানে নিয়ে যাবো, যার ফলাফল সুদূরপ্রসারী হলেও চেষ্টা থাকবে অবিরাম। আর তখনই আমি চাকরি বাদে ব্যবসাক্ষেত্রে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার কথা চিন্তা করি। আর এই ইচ্ছাশক্তি কে আরো বেশি অনুপ্রেরণা ও উৎসাহিত করেছে আমার বাবা-মা সাথে আমার স্বামীর কাছ থেকে পেয়েছি পূর্ণ স্বাধীনতা, যা আমার উদ্যোক্তা জীবনকে এগিয়ে নেয়ার জন্য অনেক সাপোর্ট দিয়েছে।

২০২০ সালে করোনাকালীন সময় আমি আমার উদ্যোগের প্রথম সিদ্ধান্ত নেই। সে সময় আমি কেক ও চকলেটের উপর একটা শর্ট কোর্স করি এবং প্রথমে বাড়িতেই প্র্যাকটিস করতে থাকি। সবার পজিটিভ ফিডব্যাক আমাকে মানসিক শক্তি যোগায়, তখন আমি অনলাইন পেইজের মাধ্যমে প্রথম আমার উদ্যোগ চালু করি। আমার পেইজের নাম “Taste of Rainbow” (টেস্ট অব রেইনবো)। আমার প্রতিষ্ঠানে সবধরনের কেক ও চকলেট আমি নিজে তৈরি করি। যেহেতু খাবার আইটেম নিয়ে কাজ করি, তাই সীমিত লাভে সর্ব্বোচ ভালো সার্ভিস দেয়াটাই ছিলো আমার মূল লক্ষ্য।

শুরুতে আমি প্রায় ২০,০০০ টাকা ইনভেস্ট এর মাধ্যমে আমার উদ্যোগ শুরু করি। শুরুর দিকে কিছু দিন অফলাইন বিজনেস করলেও পরে ২০২১ সালে অনলাইন বিজনেসের সিদ্ধান্ত নেই, আর তখনই বসুন্ধরা জোন এর কোঅর্ডিনেটর শামীম আরা ডালিয়া আপুর মাধ্যমে Women and e-Commerce Trust (WE) তে যোগদান করি। যেখানে নিজের উদ্যোগকে কিভাবে ধারাবাহিক গতিতে এগিয়ে নিয়ে যেতে হয় সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারি। প্রথম দিকে কমার্শিয়াল ওয়েতে বিজনেস না করে সীমিত লাভে কাস্টমারের সন্তুষ্টি অর্জন করাই ছিলো আমার মূল লক্ষ্য। আল্লাহর রহমতে আমার উদ্যোগ জীবন শুরুর খুব অল্প সময়ে আমি আমার স্বপ্নের অনেকটা বাস্তব চিত্র খুঁজে পেয়েছি আলহামদুলিল্লাহ।

আমার মতে একজন উদ্যোক্তা হতে হলে অবশ্যই তার নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস থাকতে হবে এবং নিজের কাজকে ভালোবাসতে হবে সাথে থাকতে হবে পরিশ্রম ও সততা। আমি বিশ্বাস করি কাজের দক্ষতা ও সততার মাধ্যমেই আপনি আপনার গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবেন। যেহেতু আমার বিজনেসে আমি এখনও নতুন তাই বর্তমানে আমার ১ জন কর্মী রয়েছে ও আমি নিজেই আমার পন্য তৈরি করি।

Grey Brown Simple Photo Collage 9
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীরা পড়ালেখা শেষে চাকরি খুজঁতে ব্যস্ত থাকলেও আমার মতে চাকরি আপনাকে একটা নিদিষ্ট সময় পর্যন্ত সাপোর্ট দিবে, কিন্তু আপনি যদি আপনার উদ্যোগ কে আপনার দক্ষতার মাধ্যমে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেন, তবে তার ফলাফল আপনাকে কয়েক প্রজন্ম পর্যন্ত সাফল্য এনে দিতে পারে। তাই প্রথম দিকে আমি নিজেও চাকরিতে আগ্রহী থাকলেও পরবর্তীতে উদ্যোক্তা হয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার বিষয়টাই আমার ভালো লেগে যায়।

আমার প্রতিষ্ঠানের নাম “টেস্ট অব রেইনবো”। ২০২১ সালে অনলাইন ও অফলাইন সার্ভিসের মাধ্যমে আমার প্রতিষ্ঠান চালু করি। আমার প্রতিষ্ঠানে কাস্টমারের চাহিদা অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন ধরনের কাস্টমাইজ কেক ও চকলেট তৈরি করা হয়। আমার সিগনেচার আইটেমের মধ্যে কাস্টমাইজ কেক ও ম্যাসেঞ্জার চকলেট উল্লেখযোগ্য, যেখানে চকলেটে অথবা কেকে কাস্টমারের পছন্দ অনুযায়ী মেসেজ লিখে দেয়া হয়।

একটা সময় আমাদের দেশে নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা খুবই কম ছিলো, কারণ তারা সেভাবে কোনো সুযোগ সুবিধা পেতোনা, কিন্তু বর্তমানে নারীদের জন্য অনলাইন ও অফলাইনে অসংখ্য সুযোগ সুবিধা চালু রয়েছে। তেমনি একটি প্ল্যাটফর্মের নাম Women and e-Commerce Trust (WE) অনলাইন গ্রুপ। যেখানে ‘উই’ প্রেসিডেন্ট নাছিমা আক্তার নিশা আপু ১২ লাখের অধিক নারী উদ্যোক্তাদের নিজস্ব আত্মপরিচয়ের মাধ্যমে তাদের উদ্যোগকে এগিয়ে নেয়ার জন্য বিশেষ অবদান রাখছে এবং সেই সাথে সবধরনের আর্থিক ও সামাজিক সহযোগিতা করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এধরনের আরো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশী নারী উদ্যোক্তাদের একটি উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে দিচ্ছেন। বহু সংখ্যক বাংলাদেশী নারী এখন নিজেকে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন।

প্রতিবন্ধকতার ক্ষেত্রে আমি বলবো উদ্যোগের বিষয়ে আপনার অনুকূল ও প্রতিকূল পরিবেশ চিন্তা করেই কাজ শুরু করা উচিত। আলহামদুল্লিলাহ এখন পর্যন্ত তেমন কোনো প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হইনি। তবে কাজের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা আসতেই পারে, কিন্তু আমার মতে সঠিক পরিশ্রম ও সততার মাধ্যমে কাজ করলে সকল প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে সফলতা আপনাকে ধরা দিবেই।

আমার ক্ষেত্রে সেলের সংজ্ঞাটা একটু অন্য রকম, ঐ যে বললাম অল্প সময়ে খুব বেশি পরিমানে সেলের আশায় আমি উদ্যোগ শুরু করিনি। আমার দক্ষতাই আমার কাস্টমার কে ফিরিয়ে আনবে এটাই আমার সবসময়ের প্রচেষ্টা থাকে। আলহামদুলিল্লাহ আমার প্রত্যাশার অনেকটা বাস্তবতা আমি খুঁজে পেয়েছি। আর তখন আরো ভালো লাগে যখন আমার রিপিট কাস্টমার অনেক দূরে থেকেও আমার বাসায় এসে পণ্য নিয়ে যায়।

আরও পড়ুনঃ সৃষ্টিশীল কাজের প্রতি নেশা আমার আজন্মকালের – হাছিনা নূপুর

সরকারি বা বেসরকারি কোনো সুযোগ-সুবিধা এখনো পাইনি, তবে যদি পাই সেটার সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানকে সামনে এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করবো। আমার প্রতিষ্ঠানের সব থেকে বড় অর্জন আমার কাস্টমারের ভরসা ও বিশ্বাস, যা অটুট রেখে আমি আমার প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই।

আমার স্বপ্ন ভবিষ্যতে আমি আমার উদ্যোগ কে যেনো একটি ব্র্যান্ডে পরিনত করতে পারি ও বাংলাদেশের সব জেলাতে আমার প্রতিষ্ঠানের শাখা থাকবে। এর মাধ্যমে আমি অসহায় নারী ও পুরুষদের কর্মস্থল তৈরি করে দিতে চাই ও আমি সমাজে একজন সহযোগী হিসাবে অবদান রাখতে চাই। আল্লাহ যেনো আমার ইচ্ছা পূরণ করে সবাই সেই দোয়া করবেন।

ব্যবসাবান্ধব আইন চান কুরিয়ার মালিকরা; সেবা খাতের স্বীকৃতির দাবি

Previous article

গহনার যত্নাবলী: শান্তু হাসানাত

Next article

You may also like

2 Comments

  1. […] আরও পড়ুনঃ প্রত্যাশার বাস্তবতা খুঁজে পেয়েছেন আর… […]

  2. […] আরও পড়ুন: প্রত্যাশার বাস্তবতা খুঁজে পেয়েছেন আর… […]

Leave a reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *