উদ্যোক্তার গল্পদেশি উদ্যোক্তা

বোনের কাছ থেকে উদ্যোগের হাতেখড়ি ইসরাত জাহান মৌসুমীর

0
Untitled design 8

উদ্যোক্তা জার্নালের বিশেষ আয়োজন ‌‘উদ্যোক্তা গল্প’-র আজকের পর্বে, কথা হলো উদ্যোক্তা ইসরাত জাহান মৌসুমীর সঙ্গে। আজ শুনবো তার উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার গল্প।

আমি ইসরাত জাহান মৌসুমী, ঢাকার মেয়ে। আমার বাবা-মা সরকারি চাকরিজীবি হবার সুবাদে আমার বেড়ে উঠা আগারগাঁও তালতলা সরকারি কলোনিতে। আমি মিরপুরের সনামধন্য স্কুল মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, বাংলাদেশ নৌ বাহিনী কলেজ থেকে এইচএসসি এবং ইডেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসসি অনার্স ও এমএসসি সম্পন্ন করি।

ছোটবেলা থেকেই আমি সবসময় নিজে কিছু করার এবং কিভাবে নিজের একটা আলাদা পরিচয় হবে এটা নিয়ে খুব চিন্তা করতাম। অনার্স চলাকালীন সময়ে আমরা চার বান্ধবী মিলে একটা বিজনেস শুরু করি। কিন্তু তখন এখনকার মতো এতো উন্নত প্রযুক্তি ছিলো না, তাই আশে পাশেই সেল করতাম আমরা। এভাবে চলছিলো, পরবর্তীতে নানা পারিপার্শ্বিকতার কারণে বিজনেসটা তেমন আগাতে পারি না, চার বান্ধবীর সবাই বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

তারপর চাকরি নামক সোনার হরিণের পেছনে ছুটোছুটি করি, কিন্তু মনের কোথাও সুপ্ত ইচ্ছে ছিলো নিজেকে যেনো মেলে ধরতে পারি। আমি ছোটবেলা থেকেই ইউনিক কিছু তৈরী করার চেষ্টা করতাম। হাতের গহনা বানানো ছিলো আমার শখ। আর বেশিরভাগ আমি নিজের তৈরি করা হাতের কাজের জামা পড়তাম। সবাই খুব পছন্দ করতো, আমার বাবা-মা আমাকে অনেক উৎসাহ দিতো এসব ব্যাপারে, বিশেষ করে আমার বোন। তার কাজ ছিলো খুব নিখুঁত, তার কাজ দেখে আমি অনুপ্রাণিত হতাম।

মূলত তার কাছ থেকে আমার হাতেখড়ি। এখন বিয়ের পর আমার স্বামী আমাকে উৎসাহ দেয়। বর্তমানে আমি হাতে তৈরি বিভিন্ন গহনা, হ্যান্ড পেইন্ট এর জামা, পাঞ্জাবি ও বাচ্চাদের ড্রেস নিয়ে কাজ করি। আমার উদ্যোগের নাম “মন মঞ্জুরী”।

শুরুটা হয় আমার করোনাকালীন সময়ে। আমি তখন একটা বেসরকারি স্কুলে চাকরি করতাম। আমাদের হঠাৎ করে সকল স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পুরো বেতন বন্ধ হয়ে যায়। পেশায় শিক্ষক হওয়ায় আর কাজে ব্যস্ত থাকায় নিজের ভালো লাগাটা অনেকদিন মাটিচাপা থাকে নানা ব্যস্ততায়। সবকিছু বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মানসিকভাবে ভেঙে পড়ি, তখন আবার নিজের স্বপ্নটা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। আমি শুরু করি নিজের স্বপ্নযাত্রা।

আমার মুলধন ছিলো ৪,৫০০ টাকা, আমার স্বামী আমাকে আরো ৩,৫০০ টাকা দেয়। মোট ৮,০০০ টাকার জিনিস নিয়ে শুরু করি। একজন উদ্যোক্তার প্রথমত যে জিনিস থাকতে হয় তাহলে ধৈর্য্য ও সততা। আর এ দুটো থাকলে কখনো পিছিয়ে পড়বে না কেউ। কোনোভাবে ভয় পাওয়া যাবে না। ভয় দূর করে সময়োপযোগী চিন্তা করতে হবে উদ্যোগের জন্য যেকোনো সময়। আমার প্রতিটি কাজ আমি নিজেই করি। সাথে আমার পরিবারের সাপোর্ট তো আছেই।

নিজের প্রোডাক্ট সোর্সিং, পণ্য ডেলিভারি, পণ্যের ছবি তোলা এবং পণ্য প্যাকেজিং সবকিছু সংসারের কাজের পাশাপাশি একহাতে করতে হয় আমাকে। তবে আড়াল থেকে আমার মা আর আমার স্বামী সাহায্য করেন আমাকে। আমার স্বামী আমার পণ্য সোর্সিং এ সবসময় কাজ করার চেষ্টা করেন, আর আমার মা আমার সন্তানদের দেখাশোনা করেন দেখে কাজগুলো আমি নিশ্চিন্ত করতে পারি। আমার পরিবারের সদস্যরা যেহেতু সাপোর্ট করে আমাকে, তাই এখনো কর্মীর প্রয়োজন পড়েনি।

বাসায় করোনাকালীন সময়ে মনটা যখন খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিলো, তখন আমি Women and e-Commerce Trust (WE) এর দেখা পাই। অনেকের অনুপ্রেরণামূলক পোস্ট দেখে নিজেকে নিয়ে নতুন করে ভাবতে শিখি। আমার সবসময়ই ইচ্ছে ছিলো নিজের একটা পরিচয় হবে। আমার নিজের এমন কিছু আলাদা বৈশিষ্ট্য থাকবে, যে কাজ নিয়ে মানুষ আমাকে নতুন করে চিনতে পারবে। এটা আরো বেশি আমার মনের ভিতর জেগে উঠে নাসিমা আক্তার নিশা আপুর প্ল্যাটফর্ম থেকে। যেখানে নিশা আপু আমাদেরকে বুঝিয়েছিলো মেয়েরা চাইলে ঘরে বসে অনেক কিছু করতে পারে সংসার সামলিয়ে। তাই আমিও তখন নিজের পরিচয় তৈরী করার জন্য চেষ্টা শুরু করলাম।

আমি একজন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা। আমাদের প্রত্যেকেরই শখ যার যার সাধ্য অনুযায়ী নিজের সাধ্যমতো নিজেকে সাজানো। সবকিছু যে অনেক বেশি দামে কিনতে হবে তা কিন্তু না। ছোটখাটো গহনা কাউকে গিফট করা যায়, হাতের কাজের ইউনিক ডিজাইন দিয়ে সুন্দর একটি জামা অনেক সুন্দর করে উপস্থাপন করা যায় সাধ্যের মধ্যেই।

উদ্যোক্তা হওয়ার পর অসংখ্য প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়, বিশেষ করে একজন নারীকে। সামাজিক বিভিন্ন সমস্যার মোকাবেলা করে নারীরা। সবচেয়ে বড় যে সমস্যার সম্মুখীন হয় সেটা হচ্ছে প্রয়োজনীয় সঠিক ধারণা এবং তথ্য পাওয়া নিয়ে। তবে বর্তমানে আগের চেয়ে উদ্যোক্তার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে, যার ফলে নতুনরা এখন অনেক বেশি সহায়তা পেয়ে থাকেন।

বর্তমানে ইন্টারনেটের যুগে যোগাযোগের মাধ্যমের প্রসারের কারণে অনেক সহজ হয়েছে উদ্যোক্তাদের কার্যক্রম। প্রথমদিকে একজন উদ্যোক্তার পুঁজি কম থাকে। সেক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত একজন ব্যবসায়ীর চেয়ে ব্যাংক ঋণ পাওয়া ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার পক্ষে অনেক কঠিন হয়, তাই উদ্যোক্তাদের উৎসাহ দেয়ার জন্য বিভিন্ন দীর্ঘ জটিল পদ্ধতির ছোট ছোট সমাধান তৈরি করা উচিত বলে আমি মনে করি।

অনেক সময় দেখা যায় অনেক শ্বশুরবাড়ি আছে বউদের কাজ করা দেখতে পারে না, সেক্ষেত্রে আমি অনেক ভাগ্যবতী। আমার শ্বশুরবাড়ির সবাই আমাকে সাপোর্ট করেন। আমার কাজে কেউ বাঁধা দেয়নি আমার মা, বোন, শ্বশুর-শাশুড়িসহ আমার পুরো পরিবার আমাকে সাপোর্ট করেছে। তবে আমার কাছে মনে হয় আগে পরিবারকে সময় দিতে হবে তারপর কাজকে।

আমি একজন মা, তাই মায়ের দায়িত্ব সবার আগে করতে হবে তারপর উদ্যোগের। যদিও উদ্যোগটাও আমার আরেকটি সন্তানের মতো। ইনশাআল্লাহ আমি সেভাবে ম্যানেজ করে চলছি, পাশাপাশি আমার উদ্যোগকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। আমার খুব ভালো লাগছে আমাকে সবাই চিনছে, আমি মানুষের ভালবাসা পাচ্ছি। এজন্য ‘উই’ গ্রুপের মাধ্যমে অনেক মানুষের সাথে যেমন চেনা জানা হয়েছে, তেমনি পরিচিতি ও বেড়েছে। এতে আমার সেল আলহামদুলিল্লাহ ভালো হয়। এখন পর্যন্ত কাস্টমাররা সন্তুষ্ট হয়েছে আমার কাজে এবং সবাই অনেক বেশি পছন্দ করে আমার কাজ।

সরকারি বা বেসরকারি সহযোগীতা এখনো পায়নি। যদি কখনো পাই তাহলে তার যথাযথ ব্যবহার করবো ইনশাআল্লাহ। আমি যতোটুকু অর্জন করেছি এতে অনেক সন্তুষ্ট আলহামদুলিল্লাহ। আমাকে অনেকে মানুষ চিনতে পারে, অনেকে আমাকে ডাকে “মন মঞ্জুরী” আপু। আমি মানুষকে তাদের পছন্দ অনুযায়ী কাজ দিতে পারি, তাদেরকে সন্তুষ্ট রাখার চেষ্টা করি এটাই আমার প্রতিষ্ঠানের বড় অর্জন। আর সততা ও ধৈর্য্যের ফলে আমি রিপিট কাস্টমার পেয়েছি এবং তাদের মাধ্যমে আমি অন্যান্য কাস্টমারদের কেউ পেয়েছি।

আমার প্রতিষ্ঠান নিয়ে আমার অনেক স্বপ্ন। দেশের ৬৪ টি জেলাতে ও দেশের বাইরেও আমার সিগনেচার পণ্য হাতের তৈরি গহনা ও জামা সবার কাছে পৌঁছাবে এমনটাই প্রত্যাশা আমার। স্বপ্ন দেখি আমার প্রতিষ্ঠান একটা সনামধন্য ব্র্যান্ড হবে, দেশের বাইরে যাবে আমার পণ্য। একদিন “মন মঞ্জুরী” কে সবাই একনামে চিনবে।

দুই মেয়ে এবং স্বামীর সহযোগিতায় এগিয়ে চলছেন আলেয়া মুশতারী

Previous article

প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নারী উদ্যোক্তাদের দক্ষ করে গড়ে তুলছে ‘উই’

Next article

You may also like

Comments

Leave a reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *