উদ্যোক্তার গল্পদেশি উদ্যোক্তা

ভেজালমুক্ত পণ্য ক্রেতার দোড়গোড়ায় পৌঁছে দিতে বদ্ধপরিকর মারজিয়া সুলতানা

0
WhatsApp Image 2022 07 07 at 11.10.27 AM

উদ্যোক্তা জার্নালের বিশেষ আয়োজন ‌‘উদ্যোক্তা গল্প’-র আজকের পর্বে, কথা হলো উদ্যোক্তা মারজিয়া সুলতানার সঙ্গে। আজ শুনবো তার উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার গল্প।

আমি মারজিয়া সুলতানা। মাদারীপুর জেলার কালকিনি থানার এক ছোট্ট গ্রামে আমার জন্ম। সাত ভাই-বোনের মধ্যে সবার ছোট এবং বাবা মায়ের খুব আদরের ছিলাম। খুব সুখেই কাটছিলো আমাদের দিন। হঠাৎ কালবৈশাখী ঝড়ে আমাদের সব লন্ডভন্ড হয়ে যায়। ২০০০ সালে মাত্র পাঁচ বছর বয়সে বাবাকে হারিয়ে নিঃস্ব আমরা। তার এক বছর পরেই মা ও প্যারালাইজড হয়ে বিছানায় পড়ে গেলো। কি আর করার! আমার গন্তব্য হলো ঢাকায় বড় বোনের বাসায়। সেই থেকে এখানেই বড়ো হওয়া।

ক্লাস নাইন থেকেই আমি চাকরি করা শুরু করি। চাকরির পাশাপাশি নিজের পড়াশোনা চালিয়ে যেতাম। অনেক কষ্ট করে এইচ.এস.সি কমপ্লিট করেছিলাম। তারপর আর আগাতে পারিনি। বাবার স্বপ্ন ছিলো মেয়ে অনেক বড় ডাক্তার হবে। সেভাবেই এগুচ্ছিলাম, কিন্তু যার স্বপ্ন ছিলো সেই তো ছিলো না। তাই তার সাথে সাথে তার স্বপ্নও মাটির নিচে অন্ধকার কবরে চলে যায়।

যখন ক্লাস নাইনে পড়ি তখনই প্রথম আমি চাকরি শুরু করি। প্রথমে একটা কোম্পানির প্রমোশন এর কাজ করেছিলাম, তারপর থেকে বিভিন্ন জায়গায় কাজ করেছি। কিন্তু কখনোই তৃপ্তি পাই নাই। সবসময় মনে হয়েছে আমি নিজে যদি কিছু করতে পারতাম! সেই বাসনা আমাকে সবসময়ই তাড়া করতো। চাকরি করলেও সারাক্ষণ আমার মাথায় ঘুরতো যে, আমি কিভাবে শুরু করবো এবং কোথা থেকে শুরু করবো। সেই লক্ষ্যেই ২০২০ সালে শূন্য হাতে শুরু করে দিয়েছিলাম আমার পথচলা।

আমার এখন দুইটা পেইজ- “Marjia’s Dream” (মারজিয়া’স ড্রীম) এবং “নির্ভেজাল”। “Marjia’s Dream” এ আছে থ্রিপিস, জুয়েলারি এবং হিজাব। “নির্ভেজাল” পেইজে আছে সবধরনের অর্গানিক প্রোডাক্ট। সবরকমের গুড়া মসলা, লাল আটা, সকল প্রকার মধু, ঘি, চিনিগুড়া চাল, রেডি টু কুক কবুতর, রেডি টু কুক গরুর ভুড়ি, গরুর খাঁটি দুধ ইত্যাদি।

শুরুটা আমার খুব অন্যরকম ছিলো। বলতে গেলে একদম শুন্য থেকে আমি শুরু করেছি। যখন ২০২০ সালে করোনা মহামারি শুরু হলো, তখন আমার স্বামীর চাকরি চলে যায়, আমি খুব হতাশ হয়ে পরি। আমার একা ইনকামে কিভাবে সংসার চলবে? তখন থেকে আমার “Marjia’s Dream” এর পথচলা।

প্রথমে আমি ইনভেস্টমেন্ট এর কারনে অনেকটাই পিছিয়ে পরেছিলাম। কারন তখন আমি একদম শূন্য হাতে ছিলাম। চাকরি করার সুবাদে আমি অনেক সাপ্লায়ারকে চিনতাম, তাদের কাছ থেকে ছবি কালেক্ট করে পেইজে আপলোড করতাম। সেল হলে তাদের কাছ থেকে এনে কাস্টমার কে দিতাম। তখন আমার “Marjia’s Dream” এর প্রোডাক্ট ছিলো থ্রিপিস, হিজাব এবং জুয়েলারি।

এরপরে আমার কাপড় নিয়ে কাজ করাটা একটু টাফ হয়ে গিয়েছিলো, কারন আমি ঐ মুহুর্তে একটা বুটিক হাউস এ চাকরি করতাম। যেহেতু বুটিক হাউস এ কাজ করতাম, তাই সেই মালিক চাইতো না আমি কাপড় নিয়ে কাজ করি। তখন আমি আস্তে আস্তে কাপড় নিয়ে কাজ একটু কমিয়ে দেই। এরপরে ২০২১ সালে আমি অসুস্থতার কারণে চাকরি ছেড়ে দেই। যেহেতু অসুস্থ ছিলাম এবং আমার কাজ আমি একাই করতাম, তাই আমি কাপড়ের বিজনেসটাতে কিছুটা পিছিয়ে যাই।

তখন আমি চিন্তা করলাম ঘরে বসে কি করা যায়? আমার ঘরের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস যেমন- মশলা, সরিষার তেল, ঘি, মধু এগুলো আমার শ্বশুর বাড়ি থেকেই আসতো। যেগুলো সম্পূর্ণ হোমমেইড উপায়ে তৈরি করা হতো। সেই মূহুর্তে আমি চিন্তা করলাম আমি যেহেতু খাঁটি জিনিসগুলো ব্যাবহার করতে পারছি, সেহেতু আমি অন্যদেরকেও সেই খাঁটি জিনিসগুলো দিতে পারি। যেই ভাবা সেই কাজ। সাথে সাথে তৈরি হয়ে গেলো আমার “নির্ভেজাল”।

একজন উদ্যোক্তা হতে গেলে আসলে অনেকগুলো গুন থাকা প্রয়োজন, তার মধ্যে অন্যতম হলো ধৈর্য্য। ধৈর্য্য ধরে লেগে থাকলে যেকোনো কাজে সফলতা অনিবার্য। আর একটা ব্যাপার আজকাল অনেকেই মনে করেন হাতে একটা মোবাইল থাকলেই হয়তো আমি উদ্যোক্তা হয়ে যেতে পারবো, তবে এই ধারনাটা একদমই ভুল বিশেষ করে অনলাইন উদ্যোক্তার ক্ষেত্রে। আসলে উদ্যোক্তা হতে চাইলে বেসিক কিছু জানাশোনা অবশ্যই থাকতে হবে, তা না হলে এই প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকাটা অনেক কঠিন হয়ে যাবে।

আসলে আমি খুব ছোট একজন উদ্যোক্তা। আমার উদ্যোগ আমি একাই দেখি। আমিই আমার কর্মী। তবে হ্যা অনেক সময় আমার স্বামী আমার ডেলিভারিতে সাহায্য করে। আমার শ্বশুর-শ্বাশুড়ি আমার পন্য তৈরিতে সাহায্য করে।

আসলে আমি অনেক বছর চাকরি করেছি নিজের প্রয়োজনেই। কিন্তু একটা সময়ে আমার কাছে অন্যের অধীনে কাজ করাটা একদম বিষের মতো লাগতো। আমার সবসময় মনে হতো অন্যের অধীনে চাকরি করার চেয়ে নিজের একটা চায়ের দোকানও ভালো। হয়তো আমাকে দীর্ঘ সময় চাকরি করতে হয়েছে নিজের প্রয়োজনে, পড়াশুনা চালানোর প্রয়োজনে। তবে আমার সবসময় মন চাইতো আমি নিজে কিছু করবো।

আমার প্রতিষ্ঠান এখন একটাই রানিং আছে সেটা হচ্ছ “নির্ভেজাল”। আমার অনলাইন শপ। যেখান থেকে সব ধরনের ভেজালমুক্ত পন্যসমূহ আমি আমার কাস্টমারদের কে দিতে চেষ্টা করি সবসময়।

আমাদের দেশের প্রেক্ষাপট আগে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য উপযোগী না থাকলেও, আমার মনে হয় এখন বর্তমানে দারুন উপযোগী। বিশেষ করে কিছু অনলাইন প্ল্যাটফর্ম আছে যেগুলো আমাদের মতো ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য খুবই উপকারী। তার মধ্যে Women and e-Commerce Trust (WE) অন্যতম।

প্রতিবন্ধকতা বলতে আমি আজ পর্যন্ত যতোটুকু এসেছি, সম্পূর্ণ নিজের প্রবল ইচ্ছাশক্তির মাধ্যমে। প্রথমে অনেক প্রতিবন্ধকতা পার হয়ে আসতে হয়েছে ঘরে বাইরে সব জায়গায়। তবে হ্যা এখন আস্তে আস্তে প্রতিবন্ধকতা অনেকটাই কমে এসেছে।

আলহামদুলিল্লাহ আমার এখন প্রতি মাসে গড়ে ৩০-৪০ হাজার টাকার মতো সেল হয়। দুই ঈদের সময় তো অনেক বেশি সেল হয় আলহামদুলিল্লাহ। আসলে আমরা চেষ্টা করি সবসময় কাস্টমার কে শতভাগ খাঁটি পণ্য দিতে। আলহামদুলিল্লাহ এখন পর্যন্ত কোনো কাস্টমারের থেকে খারাপ কোনো ফিডব্যাক পাইনি। ইনশাআল্লাহ ভবিষ্যতেও এর ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে।

এখন পর্যন্ত আমি কোনো সরকারি অথবা বেসরকারি সহযোগিতা পাইনি। আমার প্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে বড় অর্জন হচ্ছে মানুষের বিশ্বাস অর্জন করতে পারা। আজ পর্যন্ত আমরা যতোজনকে আমাদের পন্য সরবরাহ করেছি, আলহামদুলিল্লাহ দু-একজন ছাড়া সবাই আমাদের রিপিট কাস্টমার। এটাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় পাওয়া।

আমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হচ্ছে, আমাদের নিত্য প্রয়োজনীয় কোনো দ্রব্যাদির জন্য “নির্ভেজাল” এ এসে কাউকে যেনো ফিরে যেতে না হয়। আমার একটা অফলাইন শপ হবে এটা আমার একটা চাওয়া। আমি চাই আমার “নির্ভেজাল” এর ভেজালমুক্ত সব পন্য সবার দোড়গোড়ায় পৌঁছে দিতে। এটাই আমার স্বপ্ন, এটাই আমার চাওয়া।

নিজের মতো অন্য নারীদেরও সাবলম্বী করতে চান আয়শা সিদ্দিকী

Previous article

সমালোচনা কে পাত্তা না দিয়ে নিজ উদ্যমে এগিয়ে চলছেন আরজুমান আক্তার

Next article

You may also like

Comments

Leave a reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *