উদ্যোক্তার গল্পদেশি উদ্যোক্তা

শিক্ষকতা ছেড়ে উদ্যোক্তা হলেন মাহ্জাবীন

3
mr1 2

উদ্যোক্তা জার্নালের বিশেষ আয়োজন ‌‘উদ্যোক্তা গল্প’-র আজকের পর্বে, কথা হলো উদ্যোক্তা মোসাম্মৎ মাহ্জাবীন’র সঙ্গে। আজ শুনবো তার উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার গল্প।

আমি মোসাম্মৎ মাহ্জাবীন। আমার জন্ম ঢাকায়। ঢাকাতেই বড় হয়েছি, পড়াশোনা করেছি। আমি কম্পিউটারের বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং কমপ্লিট করি এবং টিচিং প্রফেশনে ঢুকি। পড়াতে আমার খুবই ভালো লাগে। কিন্তু যখন আমার রাজকন্যা এই পৃথিবীতে আসে তখন কিছু শারীরিক সমস্যার কারণে আমি চাকরি ছেড়ে দেই। তারপর আমি আর চাকরি করি নি, তবে এখনো কলেজের স্টুডেন্টদের আইসিটি পড়াই।

মেয়ে যখন ছোট ছিল তখন বাসায় খুব বোরিং ফিল করতাম, একটা কিছু করতে ইচ্ছে করতো। রান্না আমার খুব ভালো লাগতো। তবে প্রতিদিনের নরমাল রান্নাবান্না না, স্পেশাল রান্না। তাই আমি কিছু কোর্স করি এবং বাসায় যখন এগুলো রান্না করতাম তখন সবাই খুব প্রশংসা করতো। বিশেষ করে বাসায় যখন কোন গেস্ট আসতো এবং আমার রান্না করা খাবার খেতো তখন সবাই বলতো, এতো মজার খাবারের কাছে রেস্টুরেন্টও হার মানাবে। বলতো তুমি একটা রেস্টুরেন্ট খুলে ফেলো। তখন খুব ইন্সপায়ারড হতাম, ভালো লাগতো। ভাবতাম যদি আসলেই একটা রেস্টুরেন্ট খুলতে পারতাম ভালো হতো!

বিশেষ করে আমার কুকিজ টা সবাই খুবই পছন্দ করতো। আমার মেয়েকে সব বাইরের দেশের কুকিজ, চকোলেট বিভিন্ন খাবার কিনে খাওয়াতাম। দেশি প্যাকেটজাত খাবারের উপর ভরসা ছিল না। তারপর যখন নিজে কুকিজ বানানো শুরু করলাম, আমার মেয়ে আমার কুকিজই সবচেয়ে বেশি পছন্দ করতো; আর বাইরের কেউ আসলে তো কথাই নেই। তারপর আস্তে আস্তে মেয়েকে বাইরের খাবার বন্ধ করে আমার তৈরি বিভিন্ন স্পেশাল খাবার দিতাম। কারণ সে বাইরের খাবারের থেকে আমার হাতের বানানো খাবার পছন্দ করতো যা ছিল পুষ্টিকর ও।

করোনা মহামারী শুরু হলে অনলাইন ভিত্তিক কেনাকাটার হার বেড়ে গেল। আমি অনলাইনে সেই সময় বেশি কেনাকাটা করতাম এবং তখনই উদ্যোক্তাদের গল্প, সফলতার গল্প পড়তাম। আর ভাবতাম আমিও তো তাদের মতো একজন সফল উদ্যোক্তা হতে পারি। ঠিক তখন থেকেই স্বপ্ন পূরণের সাহস যোগাই।

আমার উদ্যোক্তা জীবনের শুরু ২০২০ সালের আগস্ট মাসে। আমি কিছু কুকিজ বানাই, সেগুলোর কতগুলো ছবি তুলি। রাতে একটা ফেসবুক পেইজ খুলি এবং ছবিগুলো পোস্ট করি। সেই দিনই দুইটা অর্ডার আসে আলহামদুলিল্লাহ। যদিও দুইটাই আমার আত্মীয় করেছিল। তারপরও ভিষন খুশি লেগেছিল। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে যা যা কেনা লাগবে (বাটার, ময়দা, চিনি, প্যাকেট, বক্স ইত্যাদি) কিনে ফেলি। তারপর কুকিজ বানানো শুরু করলাম।

mr2

ডেলিভারি দিলাম, রিভিউ এর অপেক্ষায় রইলাম। আলহামদুলিল্লাহ! আলহামদুলিল্লাহ তারা খেয়ে খুবই প্রশংসা করলো। এরপর আমার আরো আত্মীয় স্বজন, কিছু বন্ধু-বান্ধব এবং কলেজের কয়েকজন স্যার অর্ডার করলো। তাদের রিভিউ থেকে আরো অনেকে অর্ডার আসতে লাগলো। ঢাকা থেকে ঢাকার বাইরে এভাবে দিন দিন অর্ডার বাড়তে থাকল আর রিভিউ পরিমাণ বাড়তে থাকে, আর আমার স্বপ্ন যেন পাখা মেলা শুরু করলো।

সারা দিন-রাত পরিশ্রম করতে পারতাম। এতটুকু ক্লান্তি লাগতো না খুবই ভালো লাগতো। এমনও দিন গেছে যে ভোরে নামাজ পড়ে কাজ শুরু করেছি মাঝখানে শুধু খাবার খেয়েছি আর নামায পড়েছি। কাজ করতে করতে রাত বারোটা, একটা, দুইটা বেজে গেছে তারপরও কোনো ক্লান্তি নেই। অদ্ভুত এক আনন্দ উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন। প্রথম প্রথম আমার কোনো হেল্পিং হ্যান্ড ছিল না, আমি একাই সবকিছু করতাম আর আমার হাজব্যান্ড প্যাকিং এবং হোম ডেলিভারিতে সাহায্য করেছে।

তারপর আস্তে আস্তে ডেলিভারি ম্যান এর খোঁজ নিলাম, এতে করে একটু সুবিধা হলো। তারপর হেল্পিং হ্যান্ড রাখলাম আস্তে আস্তে পরিসর বাড়ল। এরপর একসময় চিন্তা করলাম যে আমার আরও অভিজ্ঞতা প্রয়োজন। তাই আমি NHTTI তে এক বছরের ডিপ্লোমা-ইন কালিনারি আর্টস এন্ড ক্যাটারিং ম্যানেজমেন্ট এ ভর্তি হলাম ও পাশাপাশি হাইজিন কোর্স করলাম, নন-অ্যালকোহলিক এন্ড বেভারেজ কোর্স করলাম। নিজেকে আরও দক্ষ করে গড়ে তুললাম।

আলহামদুলিল্লাহ ১ বছর ৬ মাসে আমার অর্ডার সংখ্যা এখন ১,০৩৮। আমি মনে করি এটা আমার জন্য এক বিশাল ব্যাপার। আর মনে করি এটা সম্ভব হয়েছে আল্লাহর অশেষ রহমতে, পরিবারের সহযোগিতা, আমার দক্ষতা, হাইজিন মেইনটেইন করা, পুষ্টিকর, স্বাস্থ্যকর এবং মজাদার খাবার তৈরি করা হচ্ছে এই কারণে। আগে মাত্র তিন রকমের কুকিজ তৈরি করতাম। আর এখন প্রায় ১৬ রকমের কুকিজ এবং ১৫ রকমের ফ্রোজেন ফুড ও বিভিন্ন ধরনের ডেজার্ট আইটেম, পিঠা, পাউন্ড কেক, কাপ কেক এবং আরো অনেক ধরনের খাবার তৈরি করি।

আমার এখন পর্যন্ত প্রায় ৫০০ কাস্টমার। তারমধ্যে ১০০ এর বেশী রিপিট কাস্টমার। কিছু কিছু কাস্টমার আছে যারা এই দেড় বছর ধরে আমার থেকে খাবার নিচ্ছে এবং তারা খুবই সন্তুষ্ট। শুধু তাই নয়, প্রথমে আমি শুধু ঢাকায় ডেলিভারি দিতাম। তারপর ঢাকার গন্ডি পেরিয়ে ঢাকা ছাড়াও এই পর্যন্ত সারা বাংলাদেশের আমি প্রায় ১৫ টি জেলায় ডেলিভারি দিয়েছি। সিলেট, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, যশোর, খুলনা, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, পিরোজপুর বরিশাল, নোয়াখালী ও আরো অনেক জায়গায় আমার পণ্য পৌঁছিয়েছে। এছাড়া দেশের বাইরে গিয়েছে এই পর্যন্ত ৫ বার। আমি মনে করি এটা আমার জন্য বড় প্রাপ্তি।

mr3

দূর থেকে যখন উদ্যোক্তা জীবনের গল্পগুলো পড়তাম, মনে হতো এটা বুঝি খুব মসৃণ একটা পথ। কিন্তু উদ্যোক্তা জীবন যখন শুরু হয় তখন বুঝা গেল কত কষ্ট, কত বাধা-বিপত্তি, কত মানুষের কত রকম কথা শুনতে হয়েছে। তারপরও সমস্ত বাধা অতিক্রম করে মানুষের কটু কথাগুলোকে উপেক্ষা করে এগিয়ে চলেছি। অনেক সময় মনে হয়েছিল থাক যথেষ্ট হয়েছে আর না। তারপর আবার ভাবলাম কেনো মানুষের কথায় থেমে যাব? কেনো নিজের স্বপ্ন কে গলা টিপে মেরে ফেলবো? তারপর আবার শুরু করলাম পথ চলা। পরিবার থেকেও বাধা পেয়েছি, আবার পরিবার থেকেই সবচেয়ে বেশি সাপোর্ট পেয়েছি। আমার সব চেয়ে বড় সাপোর্টার হচ্ছে আমার হাসবেন্ড। পরিবার বা বাইরের লোকের কটাক্ষ বা কটু কথাকে এখন আর পাত্তা দেই না।

এখন আমি আরো দূরে যেতে চাই। অনেক বড় বড় কাজ করতে চাই। কর্পোরেট কাজ করতে চাই। আগে হয়তো ১০ জন বা ২০ জনের খাবার পাঠাতাম। শেষ আমি ৮০০ জনের খাবার তৈরি করি। এখন আমি চাই ১,০০০/২,০০০/৩,০০০ লোকের খাবার একবারে তৈরি করতে এবং সেভাবে নিজেকে গড়ে তুলছি। ইনশাআল্লাহ সততার সাথে এভাবেই আমি এগিয়ে যেতে চাই।

আগামী ৫ বছর পরে আমি চাই, আমাকে শুধু এই দেশে না দেশের বাইরেও সবাই আমার Mahjabeen’s Kitchen কে চিনবে। একনামে চিনবে, জানবে এবং এই নামটাই ওদের মাথায় আসবে তখন; যখনই চিন্তা করবে যে স্বাস্থ্যকর, পুষ্টিকর ও মজাদার খাবার। অনলাইন এর পাশাপাশি অফলাইনেও সবাই যেনো এই Mahjabeen’s Kitchen কে ভালো মতো চিনে। পাশাপাশি আমি কিছু অসহায় মানুষেরও কর্ম সংস্থানের ব্যবস্থা করতে চাই।

শরীরের ফাটা দাগ দূর করার ঘরোয়া উপায়

Previous article

এবার সঞ্চালকের ভূমিকায় জিৎ

Next article

You may also like

3 Comments

  1. আলহাদুলিল্লাহ আলহাদুলিল্লাহ । মন টা আনন্দে ভরে গেল খুশিতে

  2. অনেক অনেক অভিনন্দন মেহেজাবীন আপু ৷ আপনার উদ্যোগটা আমার ভীষণ ভালো লেগেছে ৷ আপনার সম্পর্কে জেনে প্রচন্ড অনুপ্রানিত হচ্ছি ৷ একদিন অনেক বড় হবেন আপু ৷ অনেকদূর এগিয়ে যাবেন ইনশাআল্লাহ ৷

  3. ইনশাল্লাহ ।অসংখ্য ধন্যবাদ আপু । দোয়া করবেন যেন এভাবেই এগিয়ে যেতে পারি ❤️ ।

Leave a reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *