উদ্যোক্তার গল্পদেশি উদ্যোক্তা

সন্তানের দেখভালের বিষয় চিন্তা করে শিক্ষক না হয়ে উদ্যোক্তা হলেন ইতি

1
Untitled design 1

উদ্যোক্তা জার্নালের বিশেষ আয়োজন ‌‘উদ্যোক্তা গল্প’-র আজকের পর্বে, নিজের উদ্যোগ নিয়ে কথা বলেছেন শারমিন আক্তার ইতি। চলুন শুনি তার উদ্যোক্তা জীবনের গল্প।

আমি শারমিন আক্তার ইতি। জন্ম এবং বেড়ে ওঠা নিজ জেলা পাবনাতে। আমি ১৯৮৫ সালের ৮ জানুয়ারি পাবনা সদর উপজেলার হেমায়েতপুর ইউনিয়নের ছাতিয়ানী গ্রামে জন্ম গ্রহণ করি। হেমায়েতপুরের শ্রী শ্রী ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র তপোবন উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরিক্ষায় সাফল্যের সাথে উত্তীর্ণ হই। ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনায় খুব মনোযোগী ছিলাম। বাবা বলতো আমার আম্মার অনেক ভালো পড়ালেখার দক্ষতা আছে। বাবা আগের দিনের মানুষ তাই সে খুব বেশি সহায়তা করতে পারেনি। তবে যা করেছে তার জন্য আমি ভীষণ খুশি। গ্রামের মাটিতে হাটাচলা করে আমার বেড়ে ওঠা।

যখন এসএসসি পরীক্ষা দিবো ঠিক তখনই পরিবার থেকে আমাকে বিয়ে দেয়া হলো। পরিবারের সব চেয়ে ছোট সদস্য ছিলাম আমি। বাবার বয়স হয়ছে, কখন কি হয় বলা যায় না। তাই আমার মা আমাকে বিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। বিয়ের পরে ঢাকায় এসে আজিমপুর গার্লস স্কুল এন্ড কলেজে ভর্তি হই এবং এখান থেকেই এইচএসসি পাশ করি। তারপর ইডেন মহিলা কলেজ থেকে বিএ এবং সমাজকর্ম বিষয় নিয়ে মাস্টার্স পাশ করি। আমার বিয়ের বয়স যখন দুই বছর তখন বাবা আমাদের ছেড়ে চিরবিদায় নিয়ে চলে গেলেন। আমি সেই সময় এইচএসসি পরিক্ষার্থী। খুব কষ্ট হয়েছে বাবাকে ছাড়া পরীক্ষা দিতে। বিয়ের পরে পড়ালেখা, সংসার এক হাতে সামলিয়েছি।

আমার যখন বিএ প্রথম বর্ষ পরীক্ষা তখন আমি প্রথম মা হই (আমার ছেলে রোহানের জন্ম হয়)। আমার স্বামী যদি ফর্ম ফিলাপ করে না দিতো তাহলে হয়তো আমার আর পরীক্ষা দেয়া হতো না। সেজন্য আমি তার কাছে চিরকালের জন্য কৃতজ্ঞ। মাস্টার্স ভর্তির দশ দিন পরে আমি ২য় বারের মতো মা হই। এভাবেই আমার জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ এগিয়ে চলে। ঢাকাতে সন্তানদের দেখাশোনা করার মতো কেউ ছিলো না। শিক্ষক হবার ইচ্ছা ছিলো তাই নিবন্ধন পরীক্ষায় সাফল্যের সাথে উত্তীর্ণ হলাম এবং বিএডও করলাম। কিন্তু বাচ্চা ভালোভাবে মানুষ করতে পারবো না ভেবে আর শিক্ষক হওয়া হলো না। আজ ছেলেমেয়ে বড় হয়ে গেছে, তাই মনে হচ্ছে এখন তো কিছু করতে পারি। সে তাগিদ থেকেই উদ্যোক্তা জীবনে আসা।

আমি কখনোই ভাবিনি উদ্যোক্তা হবো। আমার ইচ্ছে ছিলো পড়াশোনা শেষ করে ভালো একটা চাকরি করবো। কিন্তু পছন্দমতো চাকরি না হওয়ায় কোনোটাতেই নিয়মিত করিনি। সংসার সন্তান নিয়ে থাকার পরেও চাকরি বা উপার্জন করতে পারতাম না বলে নিজেকে বেকার মনে হতো। আমার স্বামী একজন ব্যবসায়ী। তাই তিনি ব্যবসা পেশাটাকে সাপোর্ট করতো। তার অনুপ্রেরণা এবং আমার মেয়ের সাহায্যে উদ্যোগ শুরু করতে পেরেছি আলহামদুলিল্লাহ।

শুরুটা থ্রিপিস দিয়ে হলেও আস্তে আস্তে উদ্যোগে বিভিন্ন পণ্য যুক্ত করি। বর্তমানে থ্রিপিসের পাশাপাশি মেয়েদের আরো অন্যান্য পোশাক নিয়ে কাজ করছি। খাদ্য পণ্য হিসেবে আমার নিজ জেলার ঐতিহ্যবাহী পণ্য ঘি, ঘিয়ে ভাজা লাচ্ছা সেমাই এবং সিজনাল মধু নিয়ে কাজ করছি। সবসময় চেষ্টা করি একটু রিজেনেবল প্রাইসের মধ্যে মানসম্মত পণ্য কাস্টমারের হাতে তুলে দেয়ার এবং আলহামদুলিল্লাহ প্রায় বেশিরভাগ কাস্টমারই আমার পণ্য ক্রয় করে সন্তুষ্ট।

আমার উদ্যোগের নাম “Rohan’s Mart” (রোহান’স মার্ট)। এই পেজটা খুলেছিলাম বেশ কয়েকবছর আগে। কিন্তু তখনও ভাবিনি উদ্যোক্তা হবো। ২০২০ সালের শেষের দিকে এসে মনে হলো চাকরি তো করতে পারলাম না, তবে কিছু একটা করতে হবে আমার। সেই পরিকল্পনা থেকেই তেমন কোনো প্ল্যান সেট না করেই ২০,০০০ টাকা দিয়ে থ্রিপিস কিনে শুরু করি আমার উদ্যোগ। প্রথম প্রথম তেমন কিছু বুঝতাম না, তাই অনেক সমস্যার মুখোমুখি হতে হতো। তবে ধীরে ধীরে তা শুধরে নিয়েছি।

Untitled design 1 1
একজন উদ্যোক্তা হতে হলে অবশ্যই মনোবল, ইচ্ছাশক্তি এবং ধৈর্যশীল হওয়া প্রয়োজন। সবার আগে কিছু সাজানো গোছানো প্ল্যান সেট করা গুরুত্বপূর্ণ। এতে করে শুরুর পথটা অনেক সহজ হবে বলে আমি মনে করি।

আমার ইচ্ছে ছিলো পড়ালেখা শেষ করে চাকরি করবো। এক্ষেত্রে পরিবারের কারো বাঁধা ছিলো না। কিন্তু মনমতো চাকরি না পাওয়ায় এবং দুই সন্তানের দেখভালো করার কারণে তা আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি। কিন্তু একজন উদ্যোক্তা হওয়ার মাধ্যমে আমি স্বাধীনভাবে চলতে পারি, নিজের যা মনে হয় তাই করতে পারি। শুধু তাই নয়, আমার নিয়মিত যে কাজগুলো করা আবশ্যক সেগুলোও উদ্যোগ সামলানোর পাশাপাশি করতে পারি।

আমার প্রতিষ্ঠানের নাম “Rohan’s Mart”। ছেলের নামে খোলা “Rohan’s Mart” এর যাত্রাটা শুরু হয়েছিলো অনলাইনের মাধ্যমে। বর্তমানে ঢাকার এলিফ্যান্ট রোড এড়িয়াতে শপও আছে।

পড়াশোনা শেষ করে বেশিরভাগ মানুষই চায় চাকরি করতে। কিন্তু নারীদের ক্ষেত্রে এ ব্যপারটায় নানান ধরনের বাঁধা থাকে। তাই বেশীরভাগ নারীই বেকার থাকেন। তাদের জন্য উপার্জনক্ষম হওয়ার বিকল্প পন্থা হতে পারে ব্যবসা বা উদ্যোগ গ্রহণ। এর মাধ্যমে নারীরা যেমন স্বাবলম্বী হতে পারে, ঠিক তেমনই নিজের পরিচিতি গড়ে তুলতে পারে।

আরও পড়ুন: জৈব সার কারখানা গড়ে সফল কৃষি উদ্যোক্তা সাইফুল

আমি বলতে গেলে তেমন প্রতিবন্ধকতার স্বীকার হইনি। স্বামী, সন্তান, মা অনেক সাপোর্ট করতো। কিন্তু পারিপার্শ্বিক আত্নীয় স্বজনদের সাপোর্ট পাইনি বললেই চলে। তারা আড়লে আমাকে নিয়ে বিভিন্ন কথা বলতো এবং এখনও বলে। তবে সেগুলো নিয়ে তেমন ভাবিনা। নিজের যা মনে হয় সে অনুযায়ী চলার চেষ্টা করছি৷

সেল মোটামুটি সন্তোষজনক। তবে সবচেয়ে বড় কথা আমার পণ্য ক্রয় করে বেশিরভাগ কাস্টমারই সন্তুষ্ট। এর চেয়ে ভালো লাগা আর কিছুই হতে পারে না।

আমার উদ্যোগে অনেক বড় ভূমিকা রেখেছে Women & e-Commerce Trust (WE) গ্রুপ। এই গ্রুপটিতে জয়েন করি ২০২১ সালের মে মাসে। এখানে এক্টিভ থাকার মাধ্যমে অনেক নতুন নতুন ক্রেতা পেয়েছি। শুধু তাই নয়, এখানকার উদ্যোক্তাদের পোস্ট পড়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ জিনিস শিখেছি যা বর্তমানে আমার উদ্যোগে কাজে লাগাতে পেরেছি।

আমার প্রতিষ্ঠানের অর্জন বলতে এটাই বলবো যে ছোট একটা শিশুকে নিজের মতো করে বড় করতে পেরেছি। আমার প্রতিষ্ঠান কে ভবিষ্যতে একটা আস্থার জায়গা হিসেবেই দেখতে চাই। ৫ বছর পর নিজেকে একজন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই। সে লক্ষ্যেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি, বাকিটা আল্লাহর উপর ভরসা রেখেছি।

তরকারিতে অতিরিক্ত লবণ-মরিচ দিয়ে ফেললে কি করবেন জানেন?

Previous article

নারী উদ্যোক্তা তৈরির কারিগর “অন দ্য ওয়ে”

Next article

You may also like

1 Comment

Leave a reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *