উদ্যোক্তার গল্পদেশি উদ্যোক্তা

সৃষ্টিশীল কাজের প্রতি নেশা আমার আজন্মকালের- হাছিনা নূপুর

1
299517345 3199789820268605 8415457149844848372 n

উদ্যোক্তা জার্নালের বিশেষ আয়োজন ‌‘উদ্যোক্তা গল্প’-র আজকের পর্বে, কথা হলো উদ্যোক্তা হাছিনা নূপুরের সঙ্গে। আজ শুনবো তার উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার গল্প।

আসসালামু আলাইকুম। আমি হাছিনা নূপুর। জন্মস্থান ফরিদপুর। শৈশব এবং বেড়ে ওঠা ফরিদপুরেই। বাবার কর্মসূত্রে কৈশোরের কতগুলো বছর কেটেছে রংপুর শহরে। কৈশোরের স্বপ্নময় দিনগুলো পেরোতে না পেরোতেই বসতে হয় বিয়ের পিঁড়িতে। মাত্র ১৪ বছর বয়সে বিয়ে হয়, তারপর জড়িয়ে পড়তে হয় সংসার জীবনে। ১৫ বছর বয়সে প্রথম সন্তানের মা হই।

পরনির্ভরশীলতা আমার কখনোই পছন্দ ছিলোনা। ছোটবেলা থেকেই আমি একটু স্বাধীনচেতা মানুষ। স্বপ্ন দেখতাম নিজের একটা জগৎ থাকবে, আমি নিজেই নিজের অধীন। আত্মনির্ভরশীল হবো। অদম্য ইচ্ছাশক্তি কাজ করতো নিজের মতো করে নিজের একটা পরিচয় গড়ে তুলবো, নিজস্ব একটা সত্ত্বা থাকবে, মানসিক স্বাধীনতা, প্রশান্তি থাকবে। আমাকে আমার নামে চিনবে। উৎসাহ, প্রেরণা, সহযোগিতা যেটাই বলিনা কেনো কোনোটাই আমার ছিলোনা। ওই যে আত্মনির্ভরশীল এবং মানসিক স্বাধীনতার তাগিদে একাই সংগ্রাম করেছি।

আমি সম্পূর্ণ দেশি পণ্য নিয়ে কাজ করছি। আমার দেশের পণ্য বিশ্বদরবারে তুলে ধরার জন্য ভালোলাগা এবং ভালোবাসা থেকেই কাজ করছি তাঁত, টাই-ডাই, ব্লক ও বাটিক পণ্য নিয়ে। সাথে আছে নিজেদের তৈরী মেটাল এবং কাপড়ের গহনা। দেশের তাঁতিদের শ্রমের মূল্য দিতে, দেশের তাঁত শিল্পকে বাঁচাতেই মূলত তাঁত পণ্য নিয়ে কাজ করা।

সৃষ্টিশীল কাজের প্রতি নেশা আমার আজন্মকালের। শেখার জানার আগ্রহের কমতি নেই কখনো। নতুন কিছু জানার শেখার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি প্রতিনিয়ত। শেখার কোনো শেষ বা বয়স নেই। আত্মবিশ্বাস এবং পরিশ্রমই পারে সকল বাঁধা অতিক্রম করতে। টাই-ডাই, ব্লক-বাটিকের প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজে হাতেই এগুলো করছি এবং কিছু নারীকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছি।

আমার প্রতিষ্ঠানের নাম “Mayisha’s Collection” (মায়িশাস কালেকশন)। আমি সবসময় আমার সেরাটাই দেওয়ার চেষ্টা করি। আমি বিশ্বাস করি “সততাই ব্যবসার মূল পুঁজি”। ক্রেতার সন্তুষ্টি আমাদের বড় পাওয়া। আমাদের মূল শ্লোগানই হচ্ছে : পণ্যের গুণগতমান নিয়ে “মায়িশাস কালেকশন” সর্বদাই আপোষহীন।

শুরুর পথটা মোটেই মসৃন ছিলোনা। রক্ষনশীল পরিবারে বেড়ে ওঠা, কম বয়সে বিয়ে হওয়া তারপর থেকে হাজারটা বাঁধা নিষেধ। মেয়ে মানুষের কেনো এসব করতে হবে? কেনো বাইরের জগতে পা রাখতে হবে? কি দরকার তোমার এসব করার? খেয়ে পরে জীবন চালিয়ে নাও ব্যস।

কিন্তু আমার স্বপ্ন দমে যায়নি, এক মুহূর্তের জন্যও থেমে থাকেনি। মনের কোনে ডানা ঝাপটানো অবাধ্য স্বপ্নগুলোকে পাখা মেলতে দেয়ার জন্য একাই লড়েছি আমি। নিজের আপন মানুষগুলোর তিরস্কার অবহেলা সয়ে কখনো কখনো ভেঙে পড়েছি, হোঁচট খেয়েছি কিন্তু মনোবল হারাইনি। বারবার পিছিয়ে গিয়েও আবার এগিয়ে যাবার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে গেছি, ঘুরে দাঁড়িয়েছি। আমার আত্মবিশ্বাস আর মনের অবাধ্য স্বপ্নগুলো আমাকে হারতে দেয়নি, আমি পারবোই।

আমাদের সমাজে এমন অনেক পরিবার আছে যেখানে মেধার মূল্যায়ন করা হয়না। যদি কেউ নিজের মেধাকে কাজে লাগিয়ে কিছু একটা করে আত্মনির্ভরশীল হতে চায়, তাকে উৎসাহ তো দূরের কথা তিরস্কার আর বঞ্চনার স্বীকার হতে হয়। উদ্যোক্তা শব্দটা যে কতোটা অর্থবহ এবং সম্মানের এটা আমাদের অধিকাংশ পরিবারই বোঝেনা।

খুবই সীমিত স্বল্প কিছু নিয়ে শুরু করি একটু একটু করে। প্রথম দিকে আর্থিক বা মানসিক কোনো সাপোর্টই ছিলোনা। তিল তিল করে মনের ইচ্ছাশক্তির জোরে খুবই ছোট পরিসরে ব্যবসা চালিয়ে গেছি। শুরু থেকেই দুঃসময়ের সেই দিনগুলোতে একমাত্র সাপোর্ট এবং ভরসা ছিলো আমার মেয়ে মায়িশা। যার নামেই আমার স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান “Mayisha’s Collection”

Grey Brown Simple Photo Collage 8
সে সাথে থেকে আমার প্রোডাক্ট সোর্স, ডিজাইন, ম্যাচিং প্রতিটা কাজে আমাকে সাহায্য করেছে। সবচেয়ে বড় কথা সে সাথে থাকলে বাইরে যাওয়ার অনুমতিটা পেতে সমস্যা হতোনা। প্রথম দিকে পণ্যের ছবি তোলা এবং মডেল সে নিজেই হয়েছে। একজন উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য আত্মবিশ্বাস, কঠোর পরিশ্রম, সততা, কিছু মূলধন এবং পারিবারিক সাপোর্ট খুবই প্রয়োজন।

চাকরি মানেই পরের অধীন, নিয়ম বেঁধে জীবনযাপন। আমি স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। নিজের মেধা আর শ্রমকে কাজে লাগিয়ে আত্মনির্ভরশীল হওয়াটাই আমি গৌরবের মনে করি। চাকরি নিবোনা চাকরি দিবো। মানুষের জন্য কিছু করতে পারার মধ্যেও আত্মতৃপ্তি আছে সুখ আছে। আমি যেনো ঘরবন্দি কিছু নারীর স্বপ্নকে পাখামেলার সুযোগ করে দিতে পারি, নিজে আত্মনির্ভরশীল হয়ে আরো মানুষকে আত্মনির্ভরশীল করতে পারি সেই চিন্তাধারা থেকেই উদ্যোক্তা হওয়া।

“Mayisha’s Collection” আমার স্বপ্ন। স্বপ্নটাকে বড় করে বহুদূর যেতে চাই। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে নারীদের কিছু করা বা উদ্যোক্তা হওয়া ছিলো কল্পনাতীত কিন্তু সময় এখন পাল্টে গেছে, নারী উদ্যোক্তাদের মেধা এবং শ্রমকে মূল্যায়ন করা হচ্ছে। সরকারিভাবেই বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। উদ্যোক্তাদের নিয়ে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন গ্রুপ যেখানে অসংখ্য নারী তার মেধা এবং প্রতিভাকে কাজে লাগাচ্ছে।

রাজীব আহমেদ স্যার, নাসিমা আক্তার নিশা আপুর মতো আরো অনেকেই তৃণমূল পর্যায়ে নারীদের তুলে আনতে নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। আইসিটি মন্ত্রণালয়, ই-ক্যাব, এসএমই ফাউন্ডেশন, বিভিন্ন ব্যাংক এবং প্রতিষ্ঠান এগিয়ে এসেছে ও নারী উদ্যোক্তাদের সহযোগিতা করছে।

প্রতিবন্ধকতার তিক্ত অভিজ্ঞতা আমার মনে হয় আগের প্রশ্নের উত্তরে প্রকাশ করে ফেলেছি। প্রতিবন্ধকতা নয়, নারীর শ্রম এবং মেধাকে মূল্যায়ন করে তাকে বিকশিত হতে দিয়ে তাকে সাবলম্বী করে তোলা প্রয়োজন। একজন পুরুষের পাশাপাশি বা তার অবর্তমানে দুঃসময়ে নারী যেনো সংসারের হাল ধরতে পারে, তাকে যেনো অবহেলিত জীবন যাপন করতে না হয় সেভাবেই একজন নারীকে প্রতিষ্ঠিত হতে দেয়া উচিত।

আরও পড়ুনঃ নাচের পাশাপাশি নিজেকে সফল উদ্যোক্তা হিসেবে তৈরী কর‍তে চান বনানী এস চৌধুরী

সেল আলহামদুলিল্লাহ ভালোই। আমাদের সেবায় আমাদের কাস্টমার দাম এবং কোয়ালিটি দুইটাতেই সন্তুষ্ট। ছবিতে যেটা দেখে, পণ্য হাতে পাওয়ার পর দেখে ছবির থেকেও আরো ভালো তাহলে বুঝতেই পারছেন। আগেই বলেছি কোয়ালিটি নিয়ে কোনো আপোষ করিনা। বিশ্বাস এবং আস্থার আরেক নাম “Mayisha’s Collection”

সরকারি/বেসরকারি কোনো অনুদানই আমরা এখনো পাইনি। তবে আমাদের মতো ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য অনুদান খুবই সহায়ক। কাস্টমারের আস্থা এবং ভালোবাসা আমাদের বড় অর্জন।

ভবিষ্যতে দেশি শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই। তাঁত, টাইডাই, গ্রামীণচেক, গামছা চেক নিয়ে ভিন্ন মাত্রার কিছু করার ইচ্ছা আছে। কিছু মানুষের কর্মসংস্থান করার খুবই ইচ্ছা আছে। স্বপ্ন দেখি “মায়িশাস কালেকশন” একদিন বড় হবে এক নামে সবাই চিনবে।

পাঁচ বছর পর আত্মপ্রত্যয়ী, সাবলম্বী নারী এবং কিছু মানুষের স্বপ্নদ্রষ্টা হয়ে তাদের হৃদয়ে বেঁচে থাকতে চাই। “মাটির মানুষ আকাশ ছুঁতে চাইনা, মাটিতেই স্বপ্নগুলো কুড়াতে চাই।”

সোশ্যাল মিডিয়া ও ওটিটি প্ল্যাটফর্ম বান্ধব নীতিমালা চান উদ্যোক্তারা

Previous article

ব্যবসাবান্ধব আইন চান কুরিয়ার মালিকরা; সেবা খাতের স্বীকৃতির দাবি

Next article

You may also like

1 Comment

Leave a reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *