উদ্যোক্তার গল্পদেশি উদ্যোক্তা

স্বামী ও বোনের উৎসাহে একজন সফল উদ্যোক্তা সাবরিনা আজাদ রুমকী

0
271828896 237536975211609 8079956900693268435 n

উদ্যোক্তা জার্নালের বিশেষ আয়োজন ‌‘উদ্যোক্তা গল্প’-র আজকের পর্বে, অনলাইনে নিজের উদ্যোগ নিয়ে আলাপ করেছেন একজন সংগ্রামী উদ্যোক্তা সাবরিনা আজাদ রুমকী। চলুন শুনি তার উদ্যোগের সফলতার গল্প।

আমি সাবরিনা আজাদ রুমকী। মাদারীপুরের মেয়ে, আমার জন্ম থেকে বেড়ে উঠা মাদারীপুর শহরেই। বৈবাহিক সূত্রে বর্তমানে ঢাকা মুগদাপাড়ার বাসিন্দা।

২০২০ সালের প্যান্ডেমিক পরিস্থিতির সময় আমার বড় বোন প্রথমে আমাকে একজন উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য উৎসাহিত করেছিলেন। যেহেতু তার আগে থেকেই আমি বাসায় বিভিন্ন খাবার আইটেম টুকটাক ট্রাই করতাম। এরপর যখন এটা নিয়ে আমার স্বামীর সাথে কথা বললাম তখন সে আমাকে পুরোপুরি সহযোগিতা করলেন এ ব্যাপারে। মূলত এই দুজনের অনুপ্রেরণা থেকেই এ পথে আসা।

আমি হোমমেইড ফুড নিয়ে কাজ করছি। আমাদের দেশে কিছু ঐতিহ্যবাহী খাবার আছে যেটা সচরাচর পাওয়া গেলেও সেটা মোটেও স্বাস্থ্যসম্মত নয়। তাই সবার মাঝে হেলদি ফুড ছড়িয়ে দেয়া একইসাথে আমাদের ঐতিহ্যবাহী খাবারটাকে নতুনভাবে সবার সামনে তুলে ধরতেই আমার এ উদ্যোগটা শুরু করি। এর পাশাপাশি কর্মজীবী নারীদের কথা চিন্তা করে রেখেছি ফ্রোজেন রুটি, পরোটা আর বিভিন্ন ধরনের বাটা মশলা। যদিও আস্তে আস্তে এখানে সময়োপযোগী অন্যান্য খাবারও যুক্ত করেছি।

263394261 195838302751327 8577840956513959052 n

উদ্যোগ শুরু করার আগে অনেকেই বলতো প্রথম কয়েকমাস সেল হবে না কিন্তু ধৈর্য্য ধরে থাকতে হবে। আমিও সে অনুযায়ী মানসিকভাবে প্রস্তুত হয়েই উদ্যোগটা শুরু করেছিলাম। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে পেইজটা শুরু করার ৩/৪ দিন পর প্রথম আমি ভাজাপোড়া খাবারের পোস্ট দেই, আর সাথে সাথে আমার স্কুল জীবনের বান্ধবী ওখানের সবগুলো আইটেম অর্ডার কনফার্ম করেন। সেই থেকে এখনো পর্যন্ত ফিরে তাকাতে হয়নি আলহামদুলিল্লাহ।

একদম প্রথমে মূলধন বলতে ছিলো কিছু প্রোডাক্ট ফটোগ্রাফি। বাসার জন্য বানানো রুটি, পরোটা এবং বিভিন্ন মশলা বাটার ছবি তুলে প্রথমে দিয়েছিলাম পেইজে। এরপর বাসায় থাকা ময়দা আর আনুষাঙ্গিক জিনিসপত্র দিয়ে কিছু ভাজা আইটেম বানিয়ে পেইজে পোস্ট করলাম। প্রথম অর্ডার আসার পর ২,৮০০ টাকার জিনিসপত্র কিনেছিলাম। যেহেতু কয়েকটি আইটেম নিয়ে শুরু করেছিলাম তাই বিভিন্ন ধরনের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনেছিলাম একসাথে।

আমি মনে করি অনেকগুলো গুনের সমন্বয়ে একজন প্রকৃত উদ্যোক্তা গড়ে ওঠে। ধৈর্য্য, সততা, নিষ্ঠা, দূরদর্শিতা, বিচক্ষণতা, পরিশ্রমী, সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং ঝুঁকি নেয়ার মানসিকতা এসব একজন উদ্যোক্তার মধ্যে থাকতে হবে। আমি যেহেতু এখনো খুবই ছোট একজন উদ্যোক্তা। তাই এখন পর্যন্ত নিজের সব কাজ নিজেই করি। তবে আমার সবসময়ের জন্য সহযোগী হয়ে পাশে রয়েছেন আমার স্বামী।

259865922 1820045424852220 1606648571902298862 n

আমার আম্মু একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। এছাড়া আমার খালারাও সবাই কর্মজীবী। একদিকে সংসার অন্যদিকে চাকরি দুটো সামলানো একজন নারীর পক্ষে কতোটা কষ্টকর তা দেখে বড় হয়েছি। আম্মু চাইলেও অনেক সময় আমাদের পর্যাপ্ত সময় দিতে পারতেন না। এমনকি মাঝে মাঝে ছুটির দিনেও তাকে অফিস করতে হতো।

তাই ছোটবেলা থেকেই চাকরির প্রতি আমার কোনো আকর্ষন ছিলো না। সবসময় চিন্তা করতাম এমন কি করা যায় যেখানে আমি একইসাথে সংসার এবং আমার কাজ দুটোই সামলাতে পারবো। আর আমার মনে হয় এই দুটোকে একসাথে সামলানোর জন্য একজন নারীর সর্বোৎকৃষ্ঠ পন্থা হচ্ছে উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা।

আমার প্রতিষ্ঠানের নাম হচ্ছে “মুড়ি মুরকী”। এটা নিয়ে ২০২০ সালের আগস্টের ২৯ তারিখে যাত্রা শুরু করি। এখানে মুরালি, নিমকি, মোনাক্কা, খাজা এবং আচারসহ বিভিন্ন ধরনের বাদাম পাওয়া যায়। এসব খাবার সচরাচর পাওয়া গেলেও বাইরের খাবারে স্বাস্থ্যঝুকি থেকেই যায়। তাই আমার ক্রেতাদের স্বাস্থ্যসম্মত খাবার তুলে দিতেই আমার হাতে তৈরি খাবার নিয়ে এই প্রয়াস।

271585868 594359088298777 3156720334733630576 n

আমার মনে হয় একজন নারী উদ্যোক্তার জন্য আমাদের দেশের প্রেক্ষাপট এখনো খুব একটা সন্তাষজনক নয়। একজন নারী যখন উচ্চ শিক্ষিত হয়ে উদ্যোক্তা জীবনে প্রবেশ করতে যায় তখন ৯০% মেয়েদের প্রথম নিষেধাজ্ঞা আসে নিজের পরিবার থেকে। পরিবারের কথা থাকে অনেকটা এমন “এতো কষ্ট করে লেখাপড়া করালাম আর শেষ পর্যন্ত তুমি এটা সেল করবে? তাহলে এতো লেখাপড়া শেখার কি দরকার ছিলো?” আসলে আমাদের সমাজে নারীদের এ পেশাটাকে এখনো সম্মান দেয়া হয় না। এমনকি আমিও নিজেকে একজন উদ্যোক্তা হিসেবে পরিচিত করতে এখনো সংগ্রাম করে যাচ্ছি কাছের দূরের অনেকের সাথে।

পরিবার বা কাছের অনেকের কাছ থেকে নেতিবাচক কথা শুনলেও এটা আমার কাজে তেমন একটা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেনি। তবে এ মুহূর্তে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে ডেলিভারি দেয়াটা। অনেক সময় দেখা যায় ডেলিভারি কোম্পানিতে অর্ডার প্লেস করে কাস্টমারকে জানিয়ে রাখি আজ পার্সেল যাবে। অথবা কাস্টমার বলে আপু অন্যদিন পাঠাবেন। আমিও বলি ঠিক আছে। কিন্তু সেদিন পিক আপ করতে ডেলিভারি ম্যান আসেনি। তখন কাস্টমারের কাছে নিজের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়ে যায়। অনেক সময় কাস্টমার ভুল বোঝে আমাদের। কিন্তু এক্ষেত্রে আমাদের করার কিছুই থাকে না। আমরাও অসহায় হয়ে পড়ি।

263476542 3066610436886966 2583184050810552838 n

আলহামদুলিল্লাহ এখনো পর্যন্ত প্রায় ২০০ অর্ডার সম্পন্ন করেছি । এর মধ্যে অধিকাংশই আমার রিপিট কিংবা রেগুলার কাস্টমার। আর সেল আপডেট ১ লক্ষ ২০ হাজার প্লাস। এই এমাউন্টটা আমার টোটাল সেল আপডেট প্রফিট নয়। আমি আমার বিজনেসের দ্বিতীয় মাসে আমার মূলধন তুলে নিয়েছিলাম। বাকি টাকা দিয়েই এখনো পর্যন্ত বিজনেসটা চালিয়ে নিচ্ছি। নতুন করে আর ইনভেস্ট করতে হয়নি।

আলহামদুলিল্লাহ এখনো পর্যন্ত ৯৫% কাস্টমার আমাদের সেবায় সন্তুষ্ট। কাস্টমার যখন আমার পন্য হাতে পায় তখন অধিকাংশ কাস্টমারই তাদের সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন এবং স্বেচ্ছায় ইনবক্সে কিংবা পেইজে তাদের রিভিউ দেন। আমি এখন পর্যন্ত খুব ছোট একজন উদ্যোক্তা। তাই কোনো সরকারি বা বেসরকারি সহায়তার প্রয়োজন পড়েনি।

আমার প্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে বড় অর্জন হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি ক্রেতার আস্থাভাজন হয়ে উঠতে পেরেছে। আমার প্রতিষ্ঠানের উপর বিশ্বাস এবং ভরসা করে ক্রেতারা তাদের পছন্দের পণ্যটি কিনতে পারছেন। এছাড়া আরেকটি অর্জন হচ্ছে উদ্যোক্তা সংগঠন YEESBD আমার উপর ভরসা করে প্রতিনিয়ত সুযোগ করে দিচ্ছেন, আমার প্রতিষ্ঠানটিকে সবার মাঝে উপস্থাপন করার। এটা আমার প্রতিষ্ঠানের একটি বড় অর্জন বলে আমি মনে করি।

263986864 862167631119962 1480092946193078492 n

ইচ্ছে আছে আমার “মুড়ি মুরকী” নিয়ে অফলাইনেও কাজ করার। এছাড়া অন্য কিছু নিয়েও কাজ করার ইচ্ছে আছে অফলাইনে। স্বপ্ন দেখি নিজের একটি আউটলেট হবে। সেখানে কিছু নারীর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে, দেশের বড় বড় সব সুপারমলে মুড়ি মুরকীর লোগো বসানো পন্য থাকবে।

আগামী ৫ বছর পর নিজেকে একজন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে দেখতে চাই। অন্ততপক্ষে একজনের কাছে হলেও নিজেকে অনুকরণীয় হিসেবে দাঁড় করাতে চাই।

বিএনপিকে লবিস্ট নিয়োগ করার প্রয়োজন নেই:- গয়েশ্বর

Previous article

পুষ্টিগুণে ভরপুর রঙীন ফুলকপির দেখা মিলছে দুর্গাপুরের বাজারে

Next article

You may also like

Comments

Leave a reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *